Uncategorized

পিতার দুর্ব্যবহারে সন্তানের কর্তব্য

121672256 393260921832717 2972916412692315290 n

“আমি আমার পিতাকে কোনভাবেই সহ্য করতে পারছি না…”
(পিতার দুর্ব্যবহারে সন্তানের কর্তব্য)
▬▬▬❖✪❖▬▬▬
প্রশ্ন: পৃথিবীর একজন মানুষের সাথে আমি খুব কঠিন। আর তিনি হলেন আমার বাবা। ছোটো থেকেই তার দুর্ব্যবহার পেয়ে বড় হয়েছি। এখন আর কোনও ভাবেই সহ্য করতে পারছি না। সুতরাং প্রিয় দীনি ভাই, দয়া করে আমাকে একটু নাসিহা দিন।
উত্তর:
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, সন্তানের প্রতি পিতামাতার বিশাল হক রয়েছে। তাই মহান আল্লাহ তাদের সাথে সুন্দরতম আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাদেরকে কষ্ট দিতে বারণ করেছেন।

নিম্নের আয়াতটি লক্ষ করলে বোঝ যাবে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে কত বেশি মর্যাদা দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ۚ إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُل لَّهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
“আর তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা।
তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, নম্র ভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল: হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।” (সূরা ইসরা: ২৩ ও ২৪)

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
وَإِن جَاهَدَاكَ عَلَىٰ أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا ۖ وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا
“পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহবস্থান করবে।” (সূরা লোকমান: ১৫)
লক্ষ্য করুন, আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে রাগ ও ঘৃণার বিষয় শিরকের মত ভয়াবহ অপরাধ করতে আদেশ করার পরও তিনি পিতামাতার সাথে খারাপ ব্যবহারের সুযোগ না দিয়ে বরং দুনিয়ার জীবনে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিচ্ছেন। তাহলে আর কোথায় তাদের সাথে খারাপ আচরণের সুযোগ থাকল? আল্লাহু আকবার।

❐ কোন মানুষ যদি খারাপ আচরণ করে তাহলে তার সাথে কেমন আচরণ করতে হবে?

কোন মানুষ যদি খারাপ আচরণ করে তাহলে তার সাথে কেমন আচরণ করতে হবে আল্লাহ তাআলা তা শিক্ষা দিচ্ছেন নিম্নের আয়াতে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ۚ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ
“আর ভাল জিনিস ও মন্দ জিনিস এক সমান হতে পারে না। প্রতিহত করো তাই দিয়ে যা অধিকতর উৎকৃষ্ট, ফলে দেখো! তোমার মধ্যে ও তার মধ্যে শত্রুতা থাকলেও সে যেন ছিল অন্তরঙ্গ বন্ধু। (সুন্দর আচরণের কারণে শত্রু তোমার বন্ধুতে পরিণত হবে।)” (সূরা ফুসসিলাত: ৩৪)
এই যদি বাইরের মানুষ বা শত্রুর সাথে আচরণের নীতি হয় তাহলে আমার-আপনার নিকটতম মানুষের সাথে কেমন আচরণ হওয়া উচিৎ?

❐ দুর্ব্যবহার কারী পিতার প্রতি কেমন আচরণ করবো?

হয়ত আপনার পিতা স্বভাবগতভাবেই বদ মেজাজি ও রুক্ষ প্রকৃতির অথবা জীবনে কোনও দুর্ঘটনা বা দুর্বিপাকে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তার আচরণে এমন রুক্ষতা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু কারণ যাই হোক মানুষের জন্য অন্যের প্রতি অন্যায় আচরণ ও দুর্ব্যবহার করার সুযোগ নাই।
সুতরাং তিনি যদি তার স্ত্রীসন্তানদের প্রতি অন্যায় আচরণ করেন তাহলে আখিরাতে অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন হবে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ মানুষের প্রতিটি অন্যায় কর্মের যথোপযুক্ত বিচার করবেন।
যাহোক, এটা আপনাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা পরীক্ষা। ধৈর্যের সাথে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। তাহলে মহান আল্লাহ আপনাকে আখিরাতে বেহিসাব ভূষিত করবেন ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ বলেন,
إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُم بِغَيْرِ حِسَابٍ
“যারা ধৈর্যশীল তাদের জন্য রয়েছে এমন বিনিময় যার কোনও হিসেবই নেই।” [সূরা আয যুমার : ১০]

যে ধৈর্য ধারণের চেষ্টা করে মহান আল্লাহ তাকে ধৈর্য ধারণ করতে সাহায্য করেন:

مَن يَتَصَبَّرْ يُصَبِّرْهُ اللَّهُ، وما أُعْطِيَ أحَدٌ عَطَاءً خَيْرًا وأَوْسَعَ مِنَ الصَّبْرِ
যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করতে চায় আল্লাহ্ তাকে ধৈর্য দান করেন। ধৈর্যের চেয়ে উত্তম আর প্রশস্ত কোনও কিছু কাউকে দেয়া হয়নি।” [সহীহ আল বুখারী; সহীহ মুসলিম।]

সুতরাং তার প্রতি পাল্টা প্রতিশোধ নিবেন না, তার সাথে পাল্টা দুর্ব্যবহার করবেন না। তার সাথে ঝগড়া, রাগারাগি বা মারামারিতে লিপ্ত হবেন না।

পিতার অন্যায় আচরণ ও দুর্ব্যবহার সহ্য করার কারণে ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তাআলা আপনার গুনাহ মোচন করবেন এবং আখিরাতে পুরস্কৃত করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَا يُصِيبُ الْمُسْلِمَ مِنْ نَصَبٍ ولا وَصَبٍ ولا هَمٍّ ولا حَزَنٍ ولا أذًى ولا غَمٍّ حَتَّى الشَّوْكَةُ يُشَاكُهَا إلا كفَّرَ اللهُ بها من خَطَايَاهُ
‘মুসলিম ব্যক্তি কোন ক্লান্তি, রোগ, দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা, কষ্ট ও অস্থিরতা এমনকি কোন কাঁটা বিঁধলেও (যদি সে সবর করে ও আল্লাহর উপরে খুশী থাকে), তাহলে তার কারণে আল্লাহ তার গোনাহ সমূহ মাফ করে দেন’। [বুখারি ও মুসলিম, রিয়াযুস সালেহীন, হা/৩৭।]
এখান থেকে বুঝা গেল, কোন মানুষের খারাপ আচার-আচরণ ও কথাবার্তা দ্বারাও যদি আমরা কষ্ট পাই তাহলে আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে আমাদের গুনাহ মোচন করবেন এবং আখিরাতে মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন ইনশাআল্লাহ।

পাশাপাশি তার জন্য দুআ করবেন, যেন আল্লাহ তাকে হেদায়েত দান করেন এবং উত্তম চরিত্রে ভূষিত করেন। অনেক সময় দুআ অবিশ্বাস্য ফলাফল বয়ে আনে।

❐ যদি ধৈর্য ও সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন কী করব?

যদি ধৈর্য ও সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় তাহলে আপনি সসম্মানে আলাদা হয়ে যান বা পিতার সামনে থেকে দূরে সরে যান যেভাবে আল্লাহর নবী ইবরাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার মূর্তি পূজারী পিতা আজর এর খারাপ ব্যবহার ও হুমকি-ধমকির মুখে তাকে সালাম জানিয়ে দূরে সরে গিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা পিতাপুত্রের কথোপকথনের বিবরণ দিচ্ছেন এভাবে:
إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ يَا أَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لَا يَسْمَعُ وَلَا يُبْصِرُ وَلَا يُغْنِي عَنكَ شَيْئًا – يَا أَبَتِ إِنِّي قَدْ جَاءَنِي مِنَ الْعِلْمِ مَا لَمْ يَأْتِكَ فَاتَّبِعْنِي أَهْدِكَ صِرَاطًا سَوِيًّا – يَا أَبَتِ لَا تَعْبُدِ الشَّيْطَانَ ۖ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلرَّحْمَـٰنِ عَصِيًّا – يَا أَبَتِ إِنِّي أَخَافُ أَن يَمَسَّكَ عَذَابٌ مِّنَ الرَّحْمَـٰنِ فَتَكُونَ لِلشَّيْطَانِ وَلِيًّا – قَالَ أَرَاغِبٌ أَنتَ عَنْ آلِهَتِي يَا إِبْرَاهِيمُ ۖ لَئِن لَّمْ تَنتَهِ لَأَرْجُمَنَّكَ ۖ وَاهْجُرْنِي مَلِيًّا – قَالَ سَلَامٌ عَلَيْكَ ۖ سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّي ۖ إِنَّهُ كَانَ بِي حَفِيًّا- وَأَعْتَزِلُكُمْ وَمَا تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّـهِ وَأَدْعُو رَبِّي عَسَىٰ أَلَّا أَكُونَ بِدُعَاءِ رَبِّي شَقِيًّا
“যখন তিনি (ইবরাহিম আ.) তার পিতাকে বললেন: হে আমার পিতা, যে শোনে না, দেখে না এবং তোমার কোন উপকারে আসে না, তার উপাসনা কেন কর?
হে আমার পিতা, আমার কাছে এমন জ্ঞান এসেছে; যা তোমার কাছে আসেনি, সুতরাং আমার অনুসরণ কর, আমি তোমাকে সরল পথ দেখাব।
হে আমার পিতা, শয়তানের এবাদত করো না। নিশ্চয় শয়তান দয়াময়ের অবাধ্য।
হে আমার পিতা, আমি আশঙ্কা করি, দয়াময়ের একটি আযাব তোমাকে স্পর্শ করবে, অতঃপর তুমি শয়তানের সঙ্গী হয়ে যাবে।
পিতা বলল: যে ইব্রাহীম, তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? যদি তুমি বিরত না হও, আমি অবশ্যই প্রস্তরাঘাতে তোমার প্রাণনাশ করব। তুমি চিরতরে আমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাও।
ইব্রাহীম বললেন: সালামুন আলাইকা (তোমার উপর শান্তি হোক)। আমি আমার পালনকর্তার কাছে তোমার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করব। নিশ্চয় তিনি আমার প্রতি মেহেরবান। আমি পরিত্যাগ করছি তোমাদেরকে এবং তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদের উপাসনা কর তাদেরকে; আমি আমার পালনকর্তার ইবাদত করব। আশা করি, আমার পালনকর্তার ইবাদত করে আমি বঞ্চিত হব না।” (সূরা মারয়াম: ৪২-৪৮)

আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়েতের পথে অবিচল রাখুন এবং সুন্দর ইসলামি চরিত্রে ভূষিত করুন- যেন আমরা আমাদের পিতামাতা, স্ত্রী-পরিবার সহ সকল মানুষের সাথে সুন্দর আচরণ করতে পারি। আল্লাহুম্মা আমিন।


উত্তর প্রদান:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *