তাওহীদ এবং শিরক
মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, রাসূলুল্লাহ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর ১৪০০ বছরের অধিক কাল কেটে গেছে। তাঁর উম্মাহ আজ ছোট শিকড় থেকে বিশাল বটবৃক্ষে রূপ নিয়েছে। কিন্তু যুগের পর যুগ ক্রুসেডারদের অপ-পরিকল্পনা, শাসকদের অমনযোগীতা, দ্বীন শিক্ষার অপ্রতুলতা আর অশ্লীলতার ভয়াল থাবায় এই উম্মাহ আজ তাওহীদের জ্ঞানের অভাবে আজ দিশেহারা হয়ে নানা শিরকে জড়িয়ে পড়ছে। আজকের এই সমাজ ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছোট বড় বাহারি শিরক মানুষকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। এরই প্রেক্ষিতে, সম্মানিত আলেমে দ্বীন মওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম (রহ) তাঁর অমূল্য গ্রন্থ ‘আল-কোরআনের আলোকে শিরক ও তাওহীদ’ এ তাওহীদ এবং শিরক এর বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করেছে।
التوحيد والشرك
তাওহীদ এবং শিরক
প্রণয়নে:
শাইখ আবুল কালাম আযাদ
(লিসান্স মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদী আরব)
প্রকাশনায়
তাওহীদ পাবলিকেশন্স
ঢাকা-বাংলাদেশ
তাওহীদ এবং শিরক
সূচিপত্র
বিষয়:
- অনুবাদকের কথা
- লেখকের কথা
- তাওহীদ এবং কালিমা শাহাদাতাইনের তাৎপর্য তাওহীদ
- তাওহীদের প্রকারভেদ
- তাওহীদ ৩ ভাগে বিভক্ত
- ১. তাওহীদুর রুবূবীয়্যাহ
- ২. তাওহীদুল আসমা অস-সিফাত
- ৩. তাওহীদুল উলূহীয়্যাহ
- তাওহীদের মূল বক্তব্য
- তাওহীদের মর্মকথা
- ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’ এর তাৎপর্য
- ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’ এ কালিমা পড়ার ফযীলতসমূহ
- ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’ এর রুকনসমূহ
- ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’ এর শর্তসমূহ
- কালিমার ৭টি শর্ত
- মুহাম্মাদ (সালা হার) আল্লাহর রাসূল-এ সাক্ষ্যবাণীর তাৎপর্য
- আক্বীদা সংক্রান্ত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মাস’আলাহ
- আক্বীদা সংক্রান্ত ৩৯টি গুরুত্বপূর্ণ মাস’আলাহ
- মৃত ব্যক্তি এবং কবর সংক্রান্ত কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ মাস’আলাহ
- কবরে প্রচলিত শিরকসমূহ
- মৃত্যুর পরে প্রচলিত বিদ’আতসমূহ
- আল্লাহর সাথে শিরক করা
- ১. কবর পূজা
- ২. গায়রুল্লাহ্র নামে যবেহ করা
- ৩. যাদু, ভাগ্য গণনা ও হারানো বস্তুর সন্ধান দেওয়ার দাবী করা
- ৪. নিরাপত্তা লাভের উপায়সমূহ
- ৫. ‘গায়রুল্লাহ্’ এর নামে শপথ করা
- ৬. আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে মানত মানা
- রাশিফল ও মানব জীবনের উপর গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বাস করা
- পীর-মুর্শিদ ও অলী-আওলিয়াদের অসীলা ধরার বিধান
- শরীয়তসম্মত সঠিক অসীলার বিবরণ
- ধারণাকৃত কারামতসমূহ
- অতীত ও বর্তমান যুগের মুশরিকদের মাঝে পার্থক্য
- ভালবাসার ক্ষেত্রে আল্লাহ্র সাথে শিরক
- আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের অতি নিকটেই বিদ্যমান ।
- পীর-মুর্শিদ, অলী-আওলিয়াদের সম্পর্কে কতিপয় ভুল ধারণা
التوحيد والشرك
তাওহীদ এবং শিরক
শাইখ আবুল কালাম আযাদ
তাওহীদ এবং শিরক
অনুবাদকের কথা
نَحْمَدُهُ وَنُصَلَّى عَلَى رَسُولِهِ الكَرِيمِ أَمَّا بَعدُ:
আমরা সকলেই সেই আল্লাহ তা’আলার প্রশংসা করি, আর তাঁর সম্মানিত রাসূলের প্রতি দরূদ পাঠ করি।
অতঃপর কথা হ’লঃ আল্লাহ্ তা’আলা জ্বিন ও মানব জাতিকে সৃষ্টি করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন একমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্য, তাঁর একত্ববাদ স্বীকার করার জন্য। কিন্তু বহু জ্বিন ও ইনসান আল্লাহকে অস্বীকার করে কাফের হয়ে গেছে, আর অনেকেই আল্লাহর সাথে গাইরুল্লাহকে অংশী স্থাপন করার কারণে মুশরিক হয়ে গেছে যেমনঃ ইহুদী, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ ইত্যাদি ধর্মাবলম্বীরা। অপর দিকে একত্ববাদের ধর্ম ইসলামে বিশ্বাসী, তাওহীদের চির সেবক মুসলিম জাতি আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে এবং কালিমা তাইয়িবাহ “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্” (স) সম্পর্কে তাদের যথাযথ জ্ঞান না থাকার কারণে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে তারা আজ মুশরিক ও কাফের হয়ে গেছে। যেমনঃ শী’আদের একটি অংশ, খারেজী, রাফেযী, মু’তাযিলা, বাহাই, কাদিয়ানী, সুফীবাদী, পীর পূজারী, কবর ও মাযার পূজারী ইত্যাদি সম্প্রদায় ।
নিঃসন্দেহে একজন মুসলিমের কর্মময় জীবনে চলা-ফেরা, কথা-বার্তা, উঠা- বসা, খাওয়া-দাওয়া, চাকরি-বাকরী, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সকল প্রকার ইবাদত তাওহীদ বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত। কাজেই ঐ সমস্ত ইবাদতের ভিতরে যদি আল্লাহভীতি ও তাওহীদের প্রতিফলন ঘটে তাহ’লে ঐ ইবাদত আল্লাহ্র দরবারে গৃহীত হবে— অন্যথায় হবে না। আর এ কারণে প্রত্যেক মুসলিমের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ইবাদতের ক্ষেত্রে তাওহীদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ও পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকা একান্ত প্রয়োজন।
তাওহীদ হলো সমস্ত ভাল কাজের ভিত্তি এবং সমস্ত ইবাদতের মূল বা মাথা । পানি বিহীন নদীর যেমন কোন মূল্য নেই- ঠিক তেমনি ইবাদতের ভিতর তাওহীদের প্রতিষ্ঠা ও রাসূলুল্লা-হ (স)-এর অনুসরণ ব্যতীত ইবাদতের কোনই মূল্য নেই— সে ইবাদত যত বেশী চাকচিক্যময় হোক না কেন। বড় পরিতাপের বিষয় যে, আমাদের দেশে একদিকে রয়েছে ‘জেনারেল শিক্ষা’ যেটা ‘ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থা’। অপর দিকে রয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘খারেজী’ ও ‘আলিয়া মাদ্রাসাসমূহ’–এ সমস্ত ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হয় ঠিকই, তবে ‘তাওহীদ’ এবং ‘শিরক’ সম্পর্কে সিলেবাসভুক্ত বিস্তারিত কিছুই পড়ানো হয় না। যার ফলে আমাদের দেশের অধিকাংশ আলেম এই তাওহীদ এবং শিরক সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পান না। আর এটাই আমাদের দেশে শিরক-বিদ’আত, কবর পূজা ও পার পূজা বিস্তারের অন্যতম কারণ। তাওহীদের এই তাওহীদ এবং শিরক পুস্তকটি অনুবাদ করার ব্যাপারে সর্বোপরি মহান আল্লাহর প্রশংসা করি- এরপর সুলাই ইসলামী দা’ওয়া সেন্টারের কর্তৃপক্ষের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি— যাঁরা অনুবাদ করার সার্বিক সুযোগ করে দিয়েছেন। এরপর বন্ধুবর মাওলানা আমানুল্লাহ, মাওলানা মুকাম্মাল হক ও মাহবুবুল হক যারা অনুবাদের ভুল-ত্রুটি শুধরিয়ে দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। বিশিষ্ট ধর্মানুরাগী মুহাম্মাদ শরীফ হুসাইন পরকালীন স্বার্থে তাওহীদ এবং শিরক পুস্তিকাটি কম্পোজ করিয়ে দিয়েছেন। আব্দুল হান্নান, যিনি যত্ন সহকারে ও দ্রুততার সাথে কম্পোজের কাজ সমাধা করেছেন। এঁদের সবার প্রতি রইলো আমার কৃতজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা। আল্লাহ তা’আলা ইহ ও পরকালে তাঁদের এই সার্বিক সহযোগিতার উত্তম জাযা দান করুন। আমীন
তাওহীদ এবং শিরক এই ক্ষুদ্র পুস্তিকার মাধ্যমে সাধারণ পাঠক যদি তাওহীদের মর্মার্থ এবং “আল্লাহ্ ছাড়া সত্যিকার কোন উপাস্য নেই ও মুহাম্মাদ পোখারি : আল্লাহর রাসূল”–এ সাক্ষ্য বাণীদ্বয়ের তাৎপর্য যথাযথভাবে উপলব্ধি করে ঈমান বিধ্বংসী গায়রুল্লাহর সকল ইবাদত হ’তে মুক্ত হ’তে পারেন— তাহ’লে আমাদের শ্রম স্বার্থক হয়েছে বলে মনে করবো। এ তাওহীদ এবং শিরক পুস্তিকা সম্পর্কে পাঠক ভাইদের সুপরামর্শ সাদরে গৃহীত হবে ইনশাআল্লাহ্ ।
পরিশেষে আমার কবরবাসিনী মাতা, পিতা, সমস্ত শিক্ষাগুরু ও শ্রদ্ধাভাজনসহ সকল মু’মিন-মুসলমান নর-নারীদের জন্য আল্লাহর শাহী দরবারে এ দু’আই করব যে, হে আল্লাহ্ তুমি সকলকে ক্ষমা করো এবং পরকালীন জীবনে আমাদের সবাইকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করো । আমীন!
يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ بِرَحْمَتِكَ نَسْتَغِيْثُ – اللَّهُمَّ وَفَّقْنَا لِمَا تُحِبُّ وَتَرْضَى
ইতি
অনুবাদক,
আবুল কালাম আযাদ
তাওহীদ এবং শিরক
লেখকের কথা
إِنَّ الْحَمْدَ للهِ وَالصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ عَلَى أَشْرَفِ الأَنْبِيَاءِ وَالْمُرْسَلِينَ نَبِيِّنَا
وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ أَجْمَعِيْنَ وَبَعَدُ. مُحَمَّدٌ
সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্য। অতঃপর আমাদের নবী মুহাম্মাদ (স)-এর প্রতি দরূদ ও সালাম বর্ষিত হৌক যিনি সমস্ত নবী ও রাসূলদের মধ্য হ’তে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। অতঃপর কথা হ’লঃ মহান রাববুল আলামীন মানবজাতি এবং জ্বিনজাতিকে সৃষ্টি করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য। অর্থাৎ সকল প্রকার ইবাদতের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহকে এক বলে স্বীকার করা- আর আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকার জন্য ।
মোটকথা তাওহীদের প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তা’আলা মানুষ সৃষ্টি করে দুনিয়ায় পাঠান। আর এ উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করার জন্য মহান আল্লাহ যুগে-যুগে, কালে-কালে এক লক্ষেরও বেশী নবী ও রাসূলগণকে দুনিয়ায় প্রেরণ করেন। শুধু তাই নয়, এই তাওহীদকে মানুষের মাধ্যমে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যেই মহান আল্লাহ এই আসমান-যমীন, চন্দ্র-সূর্য, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, পশু-পাখী তথা সব কিছুই মানুষের উপকারার্থে সৃষ্টি করেছেন ।
অতএব তাওহীদের গুরুত্ব যে কত বেশী সেটা আল্লাহর এই সৃষ্টি সম্পর্কে নির্জনে একটু চিন্তা-ভাবনা করলে, গবেষণা করলে অতি সহজেই অনুধাবন করা যায়। মহান আল্লাহ তো এই দুনিয়াকে অনর্থক, বেকার ও উদ্দেশ্য ছাড়াই সৃষ্টি করেন নি ।
অতএব মানুষের জীবনে তাওহীদের গুরুত্ব অপরিসীম মনে করে সুধী পাঠক সমাজের খেদমতে তাওহীদ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে সামান্য আলোচনা এ ছোট তাওহীদ এবং শিরক পুস্তিকায় পেশ করা হ’ল । এ তাওহীদ এবং শিরক বইয়ের প্রথমাংশে অর্থঃ ‘আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার আর কোন উপাস্য নেই, আর মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর রাসূল’ এ বিষয়ে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ২য় অংশে আক্বীদা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কেননা তাওহীদের সাথে সঠিক আক্বীদার নিগুঢ় সম্পর্ক। ৩য় অংশে শিরক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কেননা তাওহীদের বিপরীত হ’ল শিরক।
অতএব ‘তাওহীদ’-কে যথাযথভাবে বুঝতে হলে শিরক সম্পর্কে অবশ্যই জ্ঞান অর্জন করতে হবে। বলা যেতে পারে যে, এক গ্লাস দুধে এক ফোটা বিষ ঢেলে দিলে যেমন ঐ দুধ সবই বিষাক্ত হয়ে যায়- ঠিক তেমনিভাবে একজন ঈমানদার ব্যক্তির জীবনের সমস্ত নেক আমলের সাথে যদি কোন শিরকী আমল মিশ্রিত হয়ে যায়- তাহ’লে তার সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে যাবে। আর ৪র্থ অংশে পীর- ফকীর ও অলী-আওলিয়াদের অসীলা ধরা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কেননা মহান আল্লাহর সাথে অংশীস্থাপনের অন্যতম প্রধান প্রকরণ হ’ল আল্লাহর নেককার বান্দাদের এবং সেই সাথে সাথে নামধারী পীর-ফকীর ও অলী-আওলিয়াদের অসীলা ধরা ।
বর্তমান আমাদের সমাজে বা দেশে অল্প শিক্ষিত ভাইদের সংখ্যা শিক্ষিত ভাইদের তুলনায় অনেক বেশী— সেহেতু খুবই সরল-সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় বইটি লেখার চেষ্টা করেছি— যাতে করে স্বল্প শিক্ষিত, শিক্ষিত এবং উচ্চ শিক্ষিত সকল শ্রেণীর পাঠক ভাইয়েরা এ তাওহীদ এবং শিরক বই থেকে বিশেষভাবে উপকৃত হতে পারেন।
একটা সাগরের সমস্ত পানি একটা মাটির কলসে ভর্তি করা যেমন আদৌও সম্ভব নয়— ঠিক তেমনিভাবে ‘তাওহীদ’, ‘আক্বীদা’, ‘শিরক’ এবং ‘অসীলা’- এ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক বিষয়গুলি এই ছোট বইতে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা আদৌ সম্ভব নয়। আমি মনে করি যে, এ তাওহীদ এবং শিরক বইটি পাঠক সমাজের বিবেকে খুব সমান্যতম সাড়া জাগাবে- এটাতে তাদের ইলমী ক্ষুধা নিবারণ হবে না । এ জন্য পাঠক ভাইদেরকে আরো অনেক পড়াশুনা করতে হবে।
এই তাওহীদ এবং শিরক বইয়ের বিভিন্নমুখী ভুল-ত্রুটি যারা সংশোধন করে দিয়েছেন, যারা এই বই লেখার ব্যাপারে এবং ছাপানোর ব্যাপারে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন, মহান রাব্বুল আলামীন তাঁদের সকলকে দুনিয়া ও আখেরাতে উত্তম বদলা দান করুন, আমীন
আমার অযোগ্যতা, অত্যধিক ব্যস্ততা এবং নির্ধারিত সময়ের ভিতর এ কাজ সমাধা করতে যেয়ে অবশ্যই অনেক ভুল-ত্রুটি হয়েছে- যেটা পাঠক সমাজের চোখে ধরা পড়বে। মেহেরবানী করে এ সমস্ত ভুল-ত্রুটিগুলি সম্পর্কে জানালে খুবই খুশী হব ।
তাওহীদ এবং শিরক
তাওহীদ
তাওহীদের শাব্দিক অর্থ হলোঃ এ এবং ই তাওহীদের অর্থ হলোঃ ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহকে এক বলে জানা, তিনি একক, তাঁর কোন অংশীদার নেই। আর এই (আলাইহিমুছছালা-তু অস-সালাম)-গণের দীন। কারো তৈরি করা দীন গ্রহণ করবেন না এবং ইসলাম ব্যতীত কোন আমলই হবে না। কেননা তাওহীদ হ’ল সমস্ত আমলের ভাত, যার উপর নির্ভর ক আমলসমূহকে প্রতিষ্ঠা করা হয় । কাজেই যখন কোন আমলের ভিতর তর্জন পাওয়া যাবে না- তখন সে আমল দ্বারা কোন লাভও হবে না। যেহেতু কোন ইবাদত তাওহীদ ছাড়া শুরু হয় না সেহেতু ঐ আমল সব নষ্ট হয়ে যাবে।
তাওহীদের প্রকারভেদ
তাওহীদ ৩ ভাগে বিভক্তঃ
১. তাওহীদুর রুবূবীয়্যাহঃ
তাওহীদুর রুবূবীয়্যাহ হলোঃ এ কথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা যে, নিশ্চয় আল্লাহ্ ছাড়া মহাবিশ্বের আর কোন প্রতিপালক নেই, যিনি তাদেরকে করেছেন এবং তাদের রুহীর ব্যবস্থা করেছেন। প্রথম যুগের মুশরিকরা এই তাওহীদে কবীয়াতকে স্বীকার করত। তারা এ কথার সাক্ষ্য দিত যে, নিশ্চয় আল্লাহ্ তাআলা এ মহাবিশ্বের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, বাদশাহ, পরিচালক, জীবন পাতা ও মৃত্যু পাতা, তিনি একক, তাঁর কোন অংশীদার নেই। যেমন আল্লাহ তাআলা মুশরিকদের সম্পর্কে বলেছেন,
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ لَيَقُولُنَ
الله فَأَنَّى يُؤفَكُونَ) (سورة العنكبوت (١٦)
অর্থঃ আর হে রাসূল! মুশরিকদেরকে আপনি যদি ঐ সমস্ত জিজ্ঞাস করেন, কে নভোমণ্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং কে চন্দ্র ও সূর্যকে নিজে করছেন, তবে তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ। সুতরাং এরপরেও আবার কোন দিকে ফিরে যাচ্ছে? (আনক- ১)
কিন্তু এ স্বীকারোক্তি এবং উপরোল্লিখিত সাক্ষ্য প্রদান তাদেরকে ইসলাম ধর্মে প্রবেশ করাতে পারে নাই এবং জাহান্নামের আগুন হ’তেও পরিত্রাণ দিতে পারে নাই, এমনকি তাদের জান ও মালকেও হিফাযত করাতে সক্ষম হয় নাই । কেননা তারা তাওহীদে উলূহিয়্যাকে যথাযথভাবে মেনে নিতে পারে নি, কারণ তাদের ইবাদতের কিছু অংশ গাইরুল্লাহর নামে উৎসর্গ করে তারা আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন করেছিল।
২. তাওহীদুল আসমা অস-সিফাত
‘তাওহীদুল আসমা অস-সিফাত’ হলো এ কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা যে, নিশ্চয় আল্লাহ্ তা’আলার পবিত্র সত্তার সাথে এবং তাঁর গুণাবলীর সাথে অন্য কোন ব্যক্তিসত্তার ও কারো কোন গুণাবলীর কোনই তুলনা নেই। এ ছাড়া একচ্ছত্রভাবে পাক ও পবিত্র আল্লাহ্র জন্যে যে সমস্ত পূর্ণাঙ্গ গুণাবলী নির্ধারিত আছে- আল্লাহ্র নামগুলিই সেই গুণাবলীর অকাট্য প্রমাণ বহন করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন,
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ) (سورة الشورى:۱۱)
অর্থঃ “তাঁর সদৃশ কোন বস্তুই নাই। তিনি সব কিছু শুনেন ও সব কিছু দেখেন।” (সূরা শূরাঃ ১১)
এমনিভাবে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর কুরআন মাজীদে নিজের পবিত্র সত্তার জন্য যে সমস্ত গুণ-বাচক নামের স্বীকৃতি প্রদান করেছেন, সেগুলিকে সমর্থন করা। এ ছাড়া রাসূলুল্লাহ্ (স) আল্লাহর জন্য যে সমস্ত গুণ-বাচক নামের স্বীকৃতি প্রদান করেছেন সেগুলিকেও সমর্থন করা। আর এ সমর্থন এমনভাবে করতে হবে— যেন ঐ সমস্ত গুণ-বাচক নাম আল্লাহর যথাযথ মহত্ত্ব, মর্যাদা ও শান-শওকতের উপযুক্ত প্রমাণ বহন করে। এখানে বিশেষ কোন গুণাবলীর তুলনা করা, সদৃশ স্থাপন করা, আল্লাহর সুন্দরতম নাম ও গুণাবলীসমূহকে অস্বীকার করা বা ঐগুলিকে আল্লাহর পবিত্র সত্তা হ’তে পৃথকভাবে চিন্তা করা, এমনিভাবে আল্লাহর সুন্দরতম নাম ও গুণাবলীসমূহের অর্থের কোন প্রকার পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও জটিল ব্যাখ্যা করা এবং মানুষের ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী ঐ সমস্ত অর্থের প্রকার বা ধরণ নির্ধারণ করা-এ সমস্ত কাজের কোনটাই জায়েয নয়।
পরিশেষে আমরা আমাদের মুখের দ্বারা, কোন ধ্যান-ধারণার দ্বারা এবং আমাদের অন্তরের দ্বারা কোন প্রকার প্রচেষ্টা চালাবো না যে, আল্লাহ্ তা’আলার গুণাবলীর মধ্য হ’তে কোন কিছু বাদ দিয়ে দিব, অথবা আমরা সৃষ্টজীবের গুণাবলীর সাথে আল্লাহর গুণাবলীর কোন সাদৃশ্য নির্ধারণ করব।
৩. তাওহীদুল উলূহীয়্যাহ:
তাওহীদুল উলূহীয়্যাহর অর্থ হলোঃ ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহকে এক বলে জানা। অর্থাৎ সকল প্রকার ইবাদত কেবল আল্লাহর জন্য করা, যা তিনি করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন দু’আ, ভয়, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভরসা, আগ্রহ, সশ্রদ্ধ ভয়-ভীতি, বিনয়-নম্রতা, আশঙ্কা-ভয়, অনুশোচনা করে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন, সাহায্য প্রার্থনা, আশ্রয় প্রার্থনা, কুরবানী বা যবাই করা, নযর বা মানত করা, আল্লাহ তা’আলা এ ব্যতীত আরো যে সমস্ত ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছেন । আল্লাহ তা’আলার কথা এর দলীল-
(وَأَنَّ المَسَاجِدَ لِلهِ فَلا تَدْعُوا مَعَ اللهِ أَحَدًا (سورة الجن (۱۸)
অর্থঃ “এবং নিশ্চয় মসজিদসমূহ আল্লাহ তা’আলাকে স্মরণ করার জন্য। অতএব তোমরা আল্লাহ তা’আলার সাথে আর কাউকে ডেকো না” (সূরা জ্বিল (১৮)। কাজেই সমস্ত ইবাদত-বন্দেগীর মধ্য হ’তে মানুষ কোন প্রকারেই কোন ইবাদত পাক-পবিত্র আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত আর কারো জন্যে করবে না। না কোন নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতার জন্য, না কোন প্রেরিত নবীর জন্য, আর আল্লাহ তা’আলার মনোনীত না কোন নেককার বান্দার জন্য। এক কথায় আল্লাহর সৃষ্টজীবের মধ্য হ’তে কারো জন্যে নয় । কেননা কোন ইবাদতই একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্যে করা জায়েয হবে না। কাজেই যে ব্যক্তি উল্লেখিত ইবাদতের মধ্য হতে কোন ইবাদত আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্যে করবে তাহ’লে সে আল্লাহর সাথে বড় ধরনের শিরক করবে, যার ফলে তার সমস্ত নেক আমল নষ্ট হয়ে যাবে।
তাওহীদের মূল বক্তব্য
তাওহীদের মূল বক্তব্য হলোঃ একমাত্র আল্লাহর ইবাদত ছাড়া আর সকলের ইবাদত হ’তে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং জান-প্রাণ দিয়ে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের দিকে অগ্রসর হওয়া। আর এটা জেনে রাখা উচিত যে- শুধু অন্তরে তাওহীদের দাবী করলে, আর মুখে শাহাদাতের কালিমা পড়লেই যথেষ্ট হবে না-যে সে মুসলিম, যতক্ষণ না সে মুশরিকদের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হবে— যেমনিভাবে মুশরিকরা গাইরুল্লাহর নিকট, মৃত ব্যক্তিদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে এবং তাদের মাধ্যমে তারা আল্লাহর নিকট সুপারিশ কামনা করে যে, তারা তাদের সকল প্রকার অসুবিধা দূর করে দিবে অথবা সেই অসুবিধাগুলিকে অন্য দিকে ফিরিয়ে দিবে। এমনিভাবে তাদের নিকট অন্য সাহায্য-সহযোগিতা কামনা করা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হবে। এ ধরনের আরো অনেক শিরকী কাজ— যেগুলো তাওহীদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী ।
তাওহীদের মর্মকথা
তাওহীদের মর্মকথা হলোঃ তাওহীদকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করা ও তার নিগুঢ় রহস্য অবহিত হওয়া এবং তার মর্মমূলে জাগ্রত জ্ঞান ও দৃঢ় আমল সহকারে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। তাওহীদের আরো তাৎপর্য হলোঃ ভয়, ভালবাসা, ভরসা, প্রার্থনা, প্রত্যাবর্তন, প্রভাব, সম্মান, শক্তিশালী হওয়া ও একনিষ্ঠতা- এ সমস্ত বিষয়ে মন ও প্রাণকে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার দিকে নিবদ্ধ করা।
মূল কথা হলোঃ গাইরুল্লাহর জন্যে কোন বান্দার মনের মণিকোঠায় কিছুই থাকবে না। আর ঐ সমস্ত জিনিসের জন্য কোন ইচ্ছাও থাকবেনা, যা আল্লাহ্ তা’আলা হারাম করে দিয়েছেন। যেমন শিরক, বিদ’আত ও পাপসমূহ- পাপ কাজসমূহ বড়ই হোক অথবা ছোটই হোক। আর সমস্ত কাজ অপছন্দ না করা- যা আল্লাহ তা’আলা পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর এটাই হলো প্রকৃতপক্ষে ‘তাওহীদ’ এবং ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ একথার মর্মবাণী ।
“লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’ এর তাৎপর্য”
‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’ (আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্যিকার মা’বূদ নেই) এর সঠিক তাৎপর্য হলোঃ ভূমন্ডলে ও নভোমন্ডলে একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন সত্যিকারের উপাস্য বা মা’বূদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন অংশীদার নেই। কেননা মিথ্যা ও ভণ্ড মা’বূদের সংখ্যা অনেক বেশি, তবে সত্যিকারের মা’বূদ হলেন একমাত্র আল্লাহ্, তিনি ‘একক’-যার কোন অংশীদার নেই। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,
ذَلِكَ بِأَنَّ اللهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِن دُونِهِ هُوَ الْبَاطِلُ وَأَنَّ اللهَ هُوَ
অর্থঃ “এটা এ কারণেও যে, আল্লাহই সত্য; আর তাঁর পরিবর্তে তারা যাকে ডাকে— তা অসত্য এবং আল্লাহই সবার উচ্চে মহান” (সূরা হজ্জ্বঃ ৬২)।
‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’-এর অর্থ শুধু এটা নয় যে- আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন সৃষ্টিকর্তা নেই, যেমন বহু মূর্খ লোকেরা এই ধারণা করে থাকে। কেননা মক্কার কুরাইশ বংশের ‘কাফের’ যাদের মাঝে রাসূলুল্লা-হ (স) কে পাঠানো হয়েছিল, তারা সকলেই একথা সহজে মেনে নিয়েছিল যে, একমাত্র আল্লাহই এ পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা ও পরিচালক। কিন্তু তারা সকলেই একথা অস্বীকার করেছিল যে- সমস্ত ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যেই প্রযোজ্য, যিনি একক, যার কোন অংশীদার নেই । যেমন আল্লাহ তা’আলা তাদের সম্পর্কে বলেছেন,
(أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهًا وَاحِدًا إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ) (سورة ص:٥)
অর্থঃ “(মক্কার কাফেররা মুহাম্মাদ (স)-কে উদ্দেশ্য করে বলেছিল) সে (মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি অ-সাল্লাম) কি বহু উপাস্যের পরিবর্তে এক উপাস্যের উপাসনা সাব্যস্ত করে দিয়েছে? নিশ্চয় এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার” (সূরা ছোয়াদঃ ৫)।

তাওহীদ এবং শিরক
Reviews
There are no reviews yet.