পাঠক শিশু গড়তে হলে
মূল : ড. আব্দুল কারীম বাক্কার
অনুবাদ : মোঃ মাহমূদুল হক ও আহমাদ রাফি
সম্পাদনা : শাইখ আবু আহমাদ সাইফুদ্দিন বেলাল মাদানী
প্রকাশনায় : দারুল কারার পাবলিকেশন্স
পরিবেশনায় : তাওহীদ পাবলিকেশন্স
পাঠক শিশু গড়তে হলে
সম্পাদকের কথা
ইবনুল কাইয়্যূম জাওযী তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ মিফতাহু দারি আস-সায়াদাহ’তে লিখেছেন-‘‘অজ্ঞতা হলো এমন একটি বৃক্ষ যেখান থেকে সমস্ত অনিষ্টতার জন্ম নেয়।’’ আর এই অজ্ঞতাকে দূর করতে প্রয়োজন বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা।
পড়া এবং বইয়ের সাথে জীবন কাটানোর মাধ্যমে একজন মানুষ তার জীবনের সাথে আরো জীবনকে যুক্ত করতে পারে। সেটা হতে পারে তার এই পৃথিবীতে জীবদ্দশায়, যেখানে সে তার এই জীবনকে অধিক বেশি আনন্দের সাথে ইতিবাচকভাবে এবং ফলপ্রসূভাবে উপভোগ করতে পারবে। আর পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পর তিনি পাবেন আরেকটি জীবন, কারণ সেই ব্যক্তিটি যে জ্ঞান রেখে যাবেন সেটা দ্বারা মানুষ উপকৃত হবে এবং তাঁর মৃত্যুর পরে মানুষ তাঁকে স্মরণ করবে-এ যেন আরেকটি জীবন।
এটা বলতেই পারি যে, শিশুদের মাঝে বই পড়ার কল্যাণকর এই অভ্যাস গড়ে তুলতে সহায়ক হবে উসত্মাদ ড. আব্দুল কারীম বাক্কার (হাফিজাহুল্লাহ)-এর এ বইটি। লেখক অত্যন্ত সুনিপূনভাবে শিশুদের বয়সের বিভিন্ন ধাপকে বিবেচনা করে গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে কিভাবে তার মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা যায় তা তুলে ধরেছেন সূচারুরূপে। একইভাবে শিশুদের মাঝে পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো রয়েছে সেগুলোর সমাধানসহ উলেস্নখ করেছেন।
বইটি অত্যন্ত চমৎকার ও যুগোপযোগী। বইটি পড়তে গিয়ে শাইখ বিন বায r এর একটি উক্তি আমার দৃষ্টিগোচর হয়। তিনি বলেছেন, ‘‘পড়ার প্রতি ভালোবাসা পরকালের নিয়ামতের পূর্বে দুনিয়াতেই দেওয়া মুমিনদের জন্য একটি নিয়ামত।’’
পরিশেষে আমি এই বইয়ের সাথে জড়িত সকলের কল্যাণ কামনা করছি। আল্লাহ তা‘আলা যেন তাদের এই মহৎ প্রচেষ্টাকে কবুল করে নেন।
আবু আহমাদ সাইফুদ্দিন বেলাল
মাকারেম আল-আখলাক ফাউন্ডেশন, উত্তরা, ঢাকা

পাঠক শিশু গড়তে হলে
সূচিপত্র
অনুবাদকের আরজ | ৯ |
ভূমিকা | ১৩ |
আমরা কেন শিশুর পাঠ-অনুরাগে উদ্যোগী হবো? | ১৫ |
একজন আদর্শ পাঠক শিশুর গঠনে যা করণীয় : | ১৬ |
কিছু আবশ্যকীয় বিষয় | ২২ |
(১). লক্ষ্য : পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা | ২২ |
(২) সময় ও সুযোগ এখনো আছে | ২৪ |
(৩). বয়সের পর্যায় এবং পড়া | ২৫ |
(৪). শিশু যা পড়ে তা তার বুঝতে পারার গুরুত্ব | ২৮ |
(৫). শিশুকে পড়াশোনা চলমান রাখায় করণীয় | ২৯ |
(৬). স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে শিশুদেরকে পড়ে শোনান | ৩০ |
(৭). শিশুদের ওয়াজ বা লেকচার শুনতে ভালো লাগে না | ৩০ |
(৮). টিভি বইয়ের শত্রম্ন | ৩২ |
(৯). পাঠে অমনোযোগিতা | ৩৩ |
(১০). শিশুদের সাথে সত্যবাদী হওয়া | ৩৫ |
(১১). শিশুরা সাধারণত যা যা পড়ে | ৩৬ |
পড়ায় অনুপ্রেরণা দানকারী পরিবেশ | ৩৯ |
পারিবারিক পরিবেশ | ৪১ |
(১). কোন জিনিস আমাদেরকে পড়াশোনা থেকে বিমুখ করে | ৪১ |
(২). পড়ুয়া পরিবার | ৪৩ |
(৩). একটি আনন্দদায়ক পরিবেশ | ৪৯ |
(৪). এতদসংশিস্নষ্ট কিছু বিষয় | ৫১ |
(৫). সাংস্কৃতিক কথোপকথন | ৫২ |
একাডেমিক পরিবেশ | ৫৪ |
শিশুর অধ্যয়ন প্রেম সৃষ্টির উপকরণ ও তার প্রয়োগ | ৬১ |
(১). আগ্রহ মহাগুণ | ৬২ |
(২). পাঠের আসরে শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণ | ৬৩ |
(৩). সবার আগে শিশুর অধ্যয়ন প্রেম সুদৃঢ়করণ | ৬৫ |
(৪). উপহার হোক বই | ৬৬ |
(৫). শিশুকে নিয়মিত পড়ে শোনানো | ৬৭ |
(৬). নিরলস উৎসাহ দান | ৬৯ |
(৭). শিশুর লেখা-পড়ার আগ্রহে জন্মে এমন সকল পন্থা অবলম্বন | ৭২ |
(৮). লাইব্রেরির সাথে শিশুর নিরব সম্পর্ক | ৭৩ |
(৯). নতুন বই চয়ন | ৭৫ |
যেভাবে শিশুকে গল্প শোনাবো | ৭৮ |
শিশুদের কেন গল্প শোনাবো? | ৭৯ |
পরিবেশ পরিচিতির গল্প | ৮০ |
মূল্যবোধ ও সভ্যতা নির্মাণে ঘটনার প্রভাব | ৮১ |
শুদ্ধ ভাষা শেখা, চর্চা এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে গল্পের ভূমিকা | ৮৩ |
(ক) এক ক্ষুধার্ত শেয়ালের শিক্ষনীয় গল্প | ৮৩ |
(খ) নদী ও সাগরের গল্প | ৮৪ |
(গ) সিংহশাবক ও এক বালকের গল্প | ৮৫ |
সামাজিক-জ্ঞান বৃদ্ধিতে গল্পের ভূমিকা | ৮৭ |
রাবার পেন্সিলের কথোপকথন | ৮৭ |
গল্প কি মুখস্থ শোনাবো-না পড়ে শোনাবো? | ৮৯ |
ঘুমপাড়ানি মাসি পিসির গল্প | ৯১ |
ঘুম-পূর্ব গল্পের আসরের গুরুত্ব | ৯২ |
গল্প নিয়ে এক যুবকের বাস্তব অভিজ্ঞতা | ৯৩ |
ঘুম-পূর্ব গল্পের আসর যেমন হবে | ৯৪ |
ঘুম-পূর্ব গল্পের আসর একটি শিল্প | ৯৫ |
গল্প, উপাখ্যানের উপযুক্ততা | ৯৫ |
সাধারণ গল্প | ৯৫ |
আকর্ষণীয় ঘটনা | ৯৬ |
যে গল্পের শেষটা আনন্দদায়ক | ৯৭ |
যে গল্প হৃদয় কাড়ে | ৯৮ |
নেতিবাচক দিক | ৯৯ |
কিশোরদের পাঠোদ্দীপনা সৃষ্টি | ১০৩ |
কিশোরদের পাঠোদ্দমী করার কিছু কলাকৌশল | ১০৪ |
কিশোররা কেন পড়তে চায় না | ১০৬ |
যে সকল উপকরণ কিশোরদের অধ্যয়নমুখী করে তোলে | ১০৭ |
পরিশেষ | ১১০ |
অনুবাদকের আরজ
الحمد لله رب العالمين, والصلاه والسلام على أشرف الأنبياء والمرسلين, سيدنا محمد وعلى آله وأصحابه أجمعين.
সবকিছুর শুরু এবং শেষ মহান আল্লাহর আল্লাহর নামেই। তিনি শুরুতে এবং তিনিই শেষে, প্রকাশ্যে ও সন্তর্পণে কেবল তার মহিমার-ই সত্মুতি।
আজকাল শিক্ষা নিয়ে কথার অভাব নেই। সহজ থেকে সহজতর হয়েছে শিক্ষা। কিন্তু চরম পতন হয়েছে এই শিক্ষার-ই!
শিক্ষা একটি বিনোদন, মানসিক আন্দোলন, চিমত্মার খেলা। ছোট-বড়ো সকলেরই সখের ঘুড়ি থাকার কথা ছিল বিদ্যাচর্চা। ইতিহাস জুড়ে বিদ্যার সাধনা ছিল সেখানেই। কিন্তু শিল্প বিপস্নবের পর থেকে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে ‘‘কর্মমুখী শিক্ষা’’ বা করে খাওয়ার জন্য শিক্ষা। আমরা এটাকে ভদ্র শব্দে প্রকাশ করে বলি ‘‘কারিগরি শিক্ষা’’। এটা মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই ছিল। বর্ণিত আছে, বাবা আদম (আঃ) এর কাছে যে ওহী আসতো; সেগুলো কারিগরি শিক্ষা কেন্দ্রিক ছিল তথা কৃষি চাষ, ঘর নির্মাণ, ফসল উৎপাদন ইত্যাদি। যুগে যুগে তার পরিসর বেড়েছে। নতুনত্ব এসেছে তাতে যুগ-যুগান্তরে।
কিন্তু মানুষ বেঁচে থাকে খাওয়ার জন্য নয়। বরং বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে খেতে হয়। তাহলে মানুষ বেঁচে থাকে কিসের জন্য? তার উদ্দেশ্য কী?
যদি বলি বিয়ে-শাদী সমত্মান-সন্ততী ও বংশ পরম্পরা পৃথিবীতে রেখে যাওয়া কিংবা ভালোভাবে পৃথিবীতে থাকতে উন্নত বসতবাড়ি নির্মাণ আমাদের উদ্দেশ্য! তখন বলবো, এসবই কিন্তু প্রাণীরা মানুষের চেয়ে ভাল পারে এবং তারা সেটা কোনো প্রকার শিক্ষা ছাড়াই অত্যন্ত নির্ভুলভাবে করে যাচ্ছে।
তাহলে মানব জাতির মানুষ হিসেবে তার বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা কোথায়? তাছাড়া সুখ অন্তর্নিহিত আপেক্ষক্ষক বিষয়। বসত্মুর ভূমিকা তাতে থাকলেও বসত্মুই মূখ্য নয়।
যদি আপনি এই প্রশ্নটি সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে বুঝতে পারবেন, মানব সৃষ্টির পেছনে একটি সুদূরপ্রসারি, সুসংহত, সুনিপুণ ও পুতপবিত্র উদ্দেশ্য রয়েছে। আর তা হলো, বিশ্বজগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহর ইবাদত ও উপাসনা করে পরকালে অবিনশ্বরে নিজের অবস্থান সুসংহত করা। নিজের আসনকে সমুন্নত করা এই অল্প সময়ে।
আমার বলার উদ্দেশ্য হলো, কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বেঁচে থাকার জন্য অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু মানুষ বেঁচে থাকবে কিসের জন্য? এই প্রশ্ন থেকেই পৃথিবীতে নবী-রাসূল প্রেরণ এর প্রয়োজনীয়তা এসেছে। সৃষ্টি হয়েছে নানাবিদ বিদ্যার। জন্ম নিয়েছে যুগ-যুগান্তরে ভূপৃষ্ঠের ক্ষণজন্মা মহাপুরুষগণ। জ্ঞান সাধনার মাধ্যমে কপালে অমরত্বের তিলক এঁটে দিয়েছে আপন ললাটে। তারা অমূল্য; কারণ অমূল্যের রত্ন জ্ঞান তাদের জ্যোতির্ময় করে দিয়েছে। যে জ্যোতির দ্যূতিতে প্রাণবন্ত এই মানব ভূমি। তারা দেখিয়েছেন, বিদ্যার উদ্দেশ্য তা দিয়ে করে খাওয়া নয়; বিদ্যার মূল্য কেবল মূল্যায়ন!
শিক্ষা হলো, একটি অপেশাদার খেলা। শিক্ষা ও জ্ঞানকে অর্থ উপার্জন এবং পদ-পদবির অনেক ঊর্ধ্বে নিয়ে না আসা পর্যন্ত বিদ্যা কোনোদিন কোনো জাতিতে আপন সৌরভ ছড়াবে না। যেমন চিড়িয়াখানায় বন্দী কোনো প্রাণী আপন গুণ ও মহিমার পেখম খোলে না।
পাখির সৌন্দর্য মুক্ত আকাশে সারিবদ্ধ নীলাভে। প্রাণীর সৌন্দর্য স্তব্ধ ঘন অরণ্যে, জঙ্গলে। তেমনি শিক্ষা ও জ্ঞানের সৌন্দর্য- অর্থোপার্জন, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রটোকলের অনেক ঊর্ধ্বে। এগুলো জ্ঞানকে অর্থের শেকলে আটকে তার সৌন্দর্য নাশ করেছে। ভূপৃষ্ঠে জন্ম নেয়া প্রতিটি মহাজ্ঞানী জীবনচরিত আপনাকে চোখে আঙুল দিয়ে তা শেখাবে।
শিক্ষা ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে বহু আগেই। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো শুরুতে কেবল বিদ্যাপীঠরূপে থাকলেও এখন সে তার খোলস বদল করেছে। যেন সুনাম সুখ্যাতি অর্থ ও অবস্থান ও রেপুটেশন তাদের এখন প্রকৃত স্বার্থকতা!
তার ওপর একটি অবুঝ শিশুকে বাবা-মা যখন আদর করে মাদ্রাসা বা স্কুলে পাঠায়; তখন মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বলে, পড়ালেখা না করলে কী করে খাবে বাবা?! কিন্তু একটু বড়ো হতে না হতেই যখন সে বুঝতে শুরু করে, তার গ্রামের সবচেয়ে ধনী মানুষগুলো অশিক্ষক্ষত অক্ষরজ্ঞানহীন! তখন তার মনে শিক্ষার যথার্থতা লোপ পায়।
শিক্ষা হয়ে ওঠে তার নিকট মূল্যহীন! কারণ শিক্ষার যে মূল্য স্কুলের প্রথম দিন তার বাবা-মা তাকে উপদেশরূপে সঙ্গ করে দিয়েছিল! তা বড়ো না হতেই তার কাছে ভুল প্রমাণিত হলো। এই কুসংস্কারের বীজ বপন হয়েছিল বহু আগেই। এরপর তার গোড়ায় পানি সিঞ্চন ও দীর্ঘ সময়ের পরিচর্যায় তা বেড়ে ওঠে এখন পত্র-পলস্নবে দেবদারু বৃক্ষক্ষর রূপ! এখন এর মূলোৎপাটন করা অসম্ভব প্রায়। তাই মানুষ ভুলতে বসেছে শিক্ষাটা আসলে কী? এখানেই মূলত এই বইটি পাঠের যথার্থতা মূল্যায়িত হবে। শিশুরা অনুসরণ করতে পছন্দ করে। ওরা কখনোই আদেশ মানতে আগ্রহী নয়। শিশুর কনসিয়াস এবং সাবকনসাস মাইন্ড হয় তীক্ষন, ঝাঁঝালো ও স্বচ্ছ। তাই শুধুমাত্র শুনে শুনেই মাতৃভাষা তার আঞ্চলিক বাঁচান ভঙ্গি সহ আয়ত্ত করে ফেলে।
একটি শিশুকে পড়াশোনায় আগ্রহী করে তোলার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ও বসন্ত ঋতু হলো প্রথম থেকে অষ্টম বছর পর্যন্ত। এ সময় তার সঠিক পরিচর্যা হলে তাকে মহা বৃক্ষ বানাতে আর খড়ি পোহাতে হয় না।
যে পরিবারের পিতা-মাতা কখনো বই ধরে দেখে না, যে ঘরে পড়াশোনা নিয়ে কোনো কথা হয়না, যে সমত্মান তার পিতা-মাতার হাতে কখনোই বই দেখে না, যার ঘরে একটি ছোট হলেও লাইব্রেরী নেই! সে সমত্মান বড়ো হতেই তার কাছ থেকে আপনি কি করে আশা করেন যে ‘‘সে পড়াশোনায় মনোযোগী হবে’’? বই প্রেমী হয়ে উঠবে?! এটি নিছক অলীক কল্পনা।
শিশুরা তাই করে যা তারা দেখে অভ্যস্ত! যে পরিবারের সদস্যরা পড়াশোনা করে, পরিবারে লাইব্রেরী রয়েছে, তাদের শিশুরা পিতা-মাতার হাতে বই দেখে বড়ো হয়। তাদের শিশুদের আর বলতে হয় না-তুমি পড়ো! বরং দেখবেনত্মঅবুঝ দু বছরের শিশুও হাতে বই নিয়ে মাথা নাড়িয়ে পড়ার অভিনয় করে!
যদি আপনি আমার এ কথা বুঝে থাকেন; তাহলে একটু চিমত্মা করে বুঝতে পারবেন, বাংলাদেশের শিক্ষার অধঃপতনের শেকড়টা আসলে কোথায়? চিকিৎসাটা কিসের করা উচিত!
পড়াশোনা ও শিক্ষা নিয়ে আরবি ইংরেজি উর্দু ও বাংলায় অনেক বই পড়া হয়েছে আমার। তার মাঝে আরববিশ্বের অতি পরিচিত নাম জনপ্রিয় শিক্ষাবিদ সিরিয়ান দার্শনিক লেখক ডক্টর আব্দুল কারীম বাক্কার লিখিত طفل يقرأ তথা ‘‘পাঠক শিশু গড়তে হলে’’ বইখানা সম্পর্কে আমাকে প্রথম তথ্য দিয়েছিল আমার পাঠের সঙ্গী আহমেদ রাফি আল-মাদানী ভাই। আমরা দুজনেই বইটি পড়ে হতচকিত হয়েছিলাম।
এক পর্যায়ে তিনি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং বলেন, এমন একটি বই আমাদের দেশে বিশেষত যেখানে শিক্ষার মূল শিকড় উপড়ে ফেলা হয়েছে যারা ভুলেই গিয়েছে শিক্ষার মানে কী(?) সেখানকার মানুষের হাতে তুলে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের কাঁধে রয়েছে! শত ব্যস্ততা এবং মদিনা ইউনিভার্সিটির পড়াশোনার ভার কাঁধে নিয়ে অনুবাদের মতো এত বড়ো দায়িত্ব নেয়া নিঃসন্দেহে কষ্টের ব্যাপার। তথাপিও আহমেদ রাফি ভাই এবং দারুল কারার পাবলিকেশন্সের পরিচালক আল-আমীন ভাইয়ের নিয়মিত পীড়াপীড়িতে কাজটি শেষ পর্যন্ত আমরা সম্পন্ন করতে পেরেছি।
এই বইটি আমি এবং আহমেদ রাফি ভাই দুজন মিলে অনুবাদ করেছি আলহামদুলিল্লাহ। অনুবাদের ক্ষক্ষত্রে আমরা স্বাধীন এবং ভাবানুবাদের আশ্রয় নিয়েছি। তাই অনেক ক্ষক্ষত্রে শব্দের সাথে মিলাতে গেলে পাঠক মূল বইয়ের খেয়া খুঁজে পাবেন না। লেখকের মনের ভাবটা বাংলাভাষীদের নিকট আমাদের প্রকাশভঙ্গিতে ব্যক্ত করার প্রচেষ্টায় আমরা ত্রুটি করিনি। তথাপিও ভুল সে থাকবেই। কারো নজরে কোনো প্রকার ভুল দৃষ্টিগোচর হলে অনুগ্রহ করে প্রকাশকের নিকট মেসেজ করে জানালে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।
পরিশেষে দারুল কারার পাবলিকেশন্স এর পরিচালক আল-আমিন ভাই এর কথা না বললেই নয়। তার নিয়মিত পীড়াপীড়ি এবং কাজের হালপুরুস্তি ব্যতীত সম্ভবত কাজটি সম্পন্ন হতো না। তাই তার প্রতি থাকলো কৃতজ্ঞতা।
পরিশেষে বাংলার একজন অভিভাবকও যদি বইটি পড়ে শিক্ষা ও জ্ঞান সাধনার এই পবিত্র যাত্রায় তার সমত্মানের সঠিক দিশা পান; তবে আমাদের সকল শ্রম সার্থক।
মোহাম্মদ মাকসুদুল হক
মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
হাদীস বিভাগ
প্রথম অধ্যায়
আমরা কেন শিশুর পাঠ-অনুরাগে উদ্যোগী হবো?
বর্ণিত আছে : ঈসা (আ.) বলেন, ‘‘শুধু রুটিই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে না’’ আর এটাই প্রকৃত বাস্তব কথা। কেননা আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টিই করেছেন রকমারি প্রয়োজনের প্রতি মুখাপেক্ষী করে। আর সে প্রয়োজনের সামান্য অংশই দখল করে আছে খাদ্য-পানি। আমাদের মেধার উন্নতি, আত্মিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষুধার পরিতৃপ্তির শেকড়ের সাথেই জড়িয়ে আছে-আমাদের মানবীয় উন্নতি আর মনুষত্বের পূর্ণতা।
এ কথা ইতিহাস জুড়েই পরিচিত যে, মানুষের জ্ঞান ও আত্মিক প্রয়োজনের চেয়ে শারিরীক ও জৈবিক প্রয়োজন অধিকতর স্পষ্ট ও তীব্র। এর কারণও অস্পষ্ট নয়, শারিরীক ও জৈবিক প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে মানুষের অস্তিত্ব; পক্ষান্তরে-জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক তৃপ্তির সাথে জড়িয়ে আছে রহস্যে ভরা মহান আল্লাহ তা‘আলার পরিচয়। নিখুঁত বাঁধনে অাঁটা ইসলামী জ্ঞানের আকাশচুম্বী ইমারত। এ-রশিতে আঁকড়ে ধরেই মানব সভ্যতা খুঁজে পায় প্রকৃত সফলতা। নিজেকে আবিষ্কার করে এক অনন্য উচ্চতায়। বিশ^-জগৎকে দেখতে শিখে প্রকৃত চশমায়। কিন্তু স্বভাবজাত প্রয়োজন হওয়া সত্ত্বেও এগুলো মানব চেতনার সোনালী সারিতে সন্নিবেশিত হয়নি।
একজন আদর্শ পাঠক শিশু গঠনে যা করণীয়
(১). কোনো কিছুর প্রতি আকর্ষণ, ঝোঁক ও প্রবণতা সৃষ্টি করে শিশুর সঠিক মানস গঠনে তার জীবনের প্রথম ছ‘টি বসন্ত সব থেকে উপযুক্ত সময়।
তাই অধ্যয়নানুরাগের বীজ তার হৃদয়ে বপন করতে এ-সময়টা যারপরনাই গুরুত্ব বহন করে। অনেক অভিভাবক আবার ধারণা করেন যে, পড়ায় মনোযোগ আর অমনোযোগ একটি জন্মগত বৈশিষ্ট্য, তাই উলেস্নখযোগ্য কোনো চেষ্টাই তারা ব্যয় করেন না, যা শিশুদের পড়ায় উদ্বুদ্ধ করবে।
আবার কেউ বিশ্বাস করেন, যে-কোনো বয়সেই শিশুকে পাঠানুরাগী করে তোলা সম্ভব; ফলে যাচ্ছেতাই করে এড়িয়ে যান বিষয়টি; আর এভাবেই শিশুরা বেড়ে ওঠে-এক পর্যায়ে কৈশোরে পদার্পণ করে অধ্যয়নের সাথে কোনো প্রকার সখ্যতা ছাড়াই।
আমাদের নিকট অসংখ্য বাস্তবতা আর চাক্ষুস প্রমাণ রয়েছে, শৈশবে যদি আমরা শিশুর কচি-হৃদয়ে বইয়ের সাথে সখ্যতা ও নিবিড় সম্পর্কের বীজ বপন করতে ব্যর্থ হই; তবে তা-যৌবনে কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। যেমন শীত-বসমেত্মর শস্য; এ-ঋতুর শুরুতে বপন না করলে, পরে তা-পূর্ণ বিকশিত হয় না; তেমনি শিশুর মনোযোগ-আগ্রহ, ঝোঁক ও প্রবণতা সৃষ্টিরও একটি উৎকৃষ্ট সময় আছে; মোটেও তাতে বিলম্ব করা উচিত নয়।
জনৈক পিতা তার সমত্মানের শৈশবে লেখা-পড়ায় অনুরাগী ও আগ্রহী করে তুলতে অবহেলা করেন; এভাবে শৈশব পেড়িয়ে কৈশোর-বসমেত্মর এগারোতে পদার্পণের পর তিনি তাতে মনোনিবেশ করেন। ততক্ষণে তার সমত্মান মনোযোগী হয়ে উঠেছে খেলাধুলায়, আসক্ত হয়ে পড়েছে সতীর্থ আড্ডায় এবং অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছে রকমারি চ্যানেল ও সিরিয়ালে-ফলে এখন বাবার কোনো প্রকার সদুপদেশ শুনছে না সে।
উল্টো বাবার কথায় অবাক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকছে, বিচলিত হয়ে বিরক্তিভাব প্রকাশ করছে। এখন বাবা অভিযোগ করে বলছে : আমি তাকে তার পছন্দের যে-কোনো বই কিনে দিতে প্রস্ত্তত; যেমনটি, তাকে বহু-মূল্যের বাই-সাইকেল কিনে দিয়েছিলাম-যখন সে ওয়াদা করেছিল যে, প্রতি সপ্তাহে একটি করে তার বয়সোপযোগী গল্প পড়বে। কিন্তু সে মুখ রক্ষা করেনি। এখন কোনো রকম করে একটি-একটি ক্লাশ নামমাত্র নাম্বার নিয়ে পার করছে…!
আমি সকল পিতা-মাতার প্রতি উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি; তারা যেন হৃদয়ঙ্গম করেন-সময়ের দ্বার সবসময়-ই তাদের সামনে উম্মুক্ত নয়, সুযোগ-সে তো অতিথি হরীণ; হাত ছাড়া হলে তার নাগাল পাওয়া অসম্ভব।
(২). জীবনের শুরু লগ্নেই অধ্যয়ন পরিশীলনে-তৎপরবর্তী একাডেমিক শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সাথে একটি সুদৃঢ় বন্ধন রয়েছে।
কারণ, শুধুমাত্র একাডেমিক পড়াশোনার উপর ভিত্তি করেই-আপন সহপাঠী সতীর্থদের ছাপিয়ে সৃজনশীলতায় তাদের উপর বিশদ ব্যবধানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন এক প্রকার দূরহ ব্যাপার। এর জন্য থাকতে হয়-অধ্যয়ন ও বইয়ের প্রতি এক অসম্ভব ঝোঁক অনুরাগ-অনুরক্তি। বই সঙ্গতায় পার করতে হয় দিনের একটি দীর্ঘ সময়। শুধু তাই নয়, তার অধ্যয়ন ও গবেষণা হতে হয় কার্যকর ও কল্যাণমুখী।
একাধিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে; নার্সারির প্রথম শ্রেণীতে একটি শিশু যে-টুকু অধ্যয়ন-দক্ষতা অর্জন করে; উচ্চ মাধ্যমিকে উঠেও ছাত্রটির শিক্ষামান বৃদ্ধির ভিত্তি হিসেবে সে আগের দক্ষতা-ই কাজ করে। তাই, শিশুদের শিক্ষার অন্তরালে পিতা-মাতাদের একটি অনিস্বীকার্য টার্গেট থাকবে তাদের বই-অনুরাগী করে তোলা।
আর অধ্যয়নকে করে তোলা-তাদের নিত্যনৈমিত্তিক পানাহার আর খেলাধুলার মতো আপন করেই। কেননা, অধ্যয়ন-বিরাগী শিশুদের অধিকাংশই শিক্ষাবৃত্তিতে দুর্বল হয়ে পড়ে; যদিও সে সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে! এর হেতুও অস্পষ্ট নয়-যখন শিশুটি বই-এর প্রতি আকর্ষণ হারায়, তখন লেখা-পড়া ও অধ্যয়নে যৎসামান্যই প্রচেষ্টা ব্যয় করে। আনন্দ খুঁজে ফিরে খেলাধুলায়, জড়িয়ে পড়ে অনর্থক কাজে। দুঃখজনকভাবে অধিকাংশ শিশুই এখন এই বলির অসহায় শিকার।
(৩). অধ্যয়ন প্রেম ও পাঠাগ্রহ শিশুকে একটি বৃহৎ উন্মুক্ত ফটকের সন্ধান দেয়; যার পথ ধরে সে বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির এক জগতে প্রবেশ করে। হাঁটি-হাঁটি, পা-পা করে ব্যাপক করে তোলে তার অনুধাবন শক্তি; আর মসৃণ করে তোলে তার কল্পনার জগৎ।
নিমেণ বিষয়টি পয়েন্ট আকারে ব্যাখ্যা করছি :
(ক) যখন অধ্যয়ন ও পড়ার প্রতি বাচ্চাদের এক প্রকার আসক্তির সৃষ্টি হয়, তখন অধ্যয়নাসক্তিই তার জীবনের প্রধান উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
আমি জীবন-বসমেত্মর এগারোতে পদার্পণ করা এক কিশোরকে লক্ষ্য করলাম; সে ‘‘সাহাবায়ে কেরামের ঘটনাবলী’’ অধ্যয়নে তন্ময় হয়ে আছে। তার মাতা-বার-বার খাবারের জন্য পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও ভালোলাগার ঘটনাটি ত্যাগ করতে পারছিল না। সে ছিল আসক্তির একাগ্রতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত।
মাঝে-মধ্যে তার পড়ার রুমটি অন্ধকার হয়ে যেত। তথাপিও মনসংযোগের ছন্দপতন হবার আশঙ্কায় আলোর জন্য উঠে দাঁড়াতো না, যেন আসক্তির মোহনায় একাকার হয়ে আছে।
সে-শিশু আজ বৃদ্ধ, পরিণতির মহীরুহ। এখন নিজ গবেষণায় সতীর্থদের ছাপিয়ে বিশ^সভায় প্রসিদ্ধ দশের একজন।
বিষয়বস্ত্তর বৈচিত্রতায় শিশুর চেতনায় বিচিত্রতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন :
হাস্যরসের গল্পে-কৌতুক কিংবা ভূতের কাহিনী পড়লে বাচ্চাদের ভেতর এক প্রকার ব্যাপক উদ্দীপনা কাজ করে। সে কাহিনী তার শিশু-মানসকে শিহরিত করে তোলে।
অন্যপক্ষক্ষ মনিষীদের জীবনচরিত অধ্যয়নে বাচ্চারা আত্মচেতনা ও মহত্ববোধ অনুভব করে। যেমনটি যুদ্ধের গল্প পড়ে নিজের বীরত্ব জাহির করে।
যখন-ই কোনো বাচ্চাকে বলতে শুনবেন-‘‘আমি অমুকের মতো হতে চাই’’, একথা সে কেবল তখনই বলে-যখন সে ঐ ব্যক্তিকে জেনে বা পড়ে তার কৃষ্টি কালচার, আচার-আচরণ সর্বোপরি তার ব্যক্তিত্বের দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত হয়।
বই পড়ার একটি নূন্যতম উপকার হলো-এটি শিশুকে উচ্চাকাঙক্ষী করে তোলে এবং বড় পরিসরে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। আর প্রত্যেক মনীষীই তার বিদ্বান হওয়ার যাত্রার শুরুটা উচ্চাকাঙক্ষা, উন্নতচিমত্মা আর বৃহৎ চূড়ার পথ ধরেই শুরু করেছেন।
(খ) হতদরিদ্রের ঘরে জন্ম নেয়া সুবিধাবঞ্চিত শিশু অথবা শিক্ষার আলো থেকে বহু দূরের পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুর জন্য শিক্ষা এবং অধ্যয়ন প্রেম মুক্তির দূত হয়ে অবতীর্ণ হয়।
এই ধ্বংসাত্মক পরিবেশ শিশুর উচ্চাকাঙক্ষার বিনাস করে। ফলে যেকোনো তুচ্ছ অবলম্বনই তাকে সন্তুষ্ট করে তোলে। এখানে শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম; যা তাকে সীমিত ও ক্ষুদ্র পরিসর থেকে বেরিয়ে মুক্ত আকাশের সন্ধান দেয়। তার গলায় চেপে ধরা কঠিন সময় থেকে বের করে ইতিহাস সম সুপ্রশস্ত দীর্ঘ পথের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
তাই অনেক শিশুর ক্ষক্ষত্রে শিক্ষাটা তার জীবন-সম গুরুত্ব বহন করে। বিশেষত হতদরিদ্র নিরক্ষর পরিবারে জন্ম নেয়া শিশুর বেলায় শিক্ষাটা অন্যের তুলনায় অধিকতার প্রয়োজন। হতাশা-নৈরাশ্য ও ভারসাহীনতা যেন উদ্যমতা হারিয়ে-কষ্টে চেপে থাকা সংকীর্ণতা তাকে গ্রাস না করে।
আর আমরা লক্ষ্য করেছি, পারিবারিক সূত্রে সাংস্কৃতিক দীক্ষা থেকে বঞ্চিত শিশুদের বেলায় বুদ্ধিবৃত্তিক জরিপগুলো তাদের মেধা যাচাই ও পরিমাপ করতে গিয়ে আশানুরূপ কিছু পেতে ব্যর্থ হয়েছে।
এখানেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, পাঠে মনোযোগী ও অধিক পড়ুয়া শিশুরা আত্মবিশ্বাসী; আচরণে উচ্চারণে সতীর্থদের মাঝে শ্রেষ্ঠত্ব ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে চলে।
এক শিশু যার বয়স পাঁচ বছর অতিক্রম করেনি। তবে এরই মধ্যে সে তার মায়ের বিশেষ নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। সে সবচেয়ে ভালো এক কিন্ডারগার্টেন এ পড়ে, যা তাকে শ্রেষ্ঠত্বের উপলদ্ধি দেয় এবং সে সম্পূর্ণ স্বাধীন ব্যক্তির মতো আচরণ করে, ভাষার ব্যতিক্রমধর্মী ব্যবহারেও সে স্বাক্ষর রেখেছে।
একবার তার বাবা একটা অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন। শিশুটি তার সাথে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তার বাবা তাকে বলল, তোমাকে আজকে এখানে থাকতে হবে, বাইরে যেতে পারবে না! কিন্তু শিশুটি অবাক করা জবাব দিয়েছিল। বলল : কি? বাবা, তুমি কি আমার বস? যে বাইরে যেতে বাধা দিচ্ছো!
এটা শুনে পিতা হেসেছিল এবং তার কথায় অবাক হয়ে গিয়েছিল এবং তাকে তার সাথে নিতে রাজি হলো। ঐ একই শিশুর সাথে তার বড় ভাই যার বয়স কিনা ৮ বছর, একদিন খারাপ ব্যবহার করেছিল। বড় ভাই তার ভুল বুঝতে পেরেছিল এবং শিশুটির কাছে সরি বলেছিল কিন্তু শিশুটি অবাক করে দিয়ে বড় ভাইকে বলল, ‘‘ইট ইজ টু লেট।’’
গ. আমাদের শিশুরা ঐসব গল্প করা এবং শোনার প্রতি মুখাপেক্ষী যেগুলো তাদের আত্মাকে উন্নত করে এবং নৈতিকতাকে পরিশোধন করে। এটা বর্তমানে বিশেষভাবে সত্য, যেখানে সহানুভূতি স্থলাভিষিক্ত হয়ে যাচ্ছে আধিপত্য দ্বারা এবং সমতা ও পরোপকারিতাকে স্থলাভিষিক্ত হয়ে যাচ্ছে স্বার্থপরতা দ্বারা। বিশেষ করে এমন সময়ে যখন মানুষ এগুলোর প্রতি প্রবল মুখাপেক্ষী।
এক মা লক্ষ করলেন, তার ১১ বছরের মেয়েটির যেকোনো জিনিস তার নিজের করে নেওয়ার জন্য প্রবল আগ্রহ রয়েছে, এমনকি যে জিনিস তার নয় এমন জিনিস নিজের বলে দাবি করতে সে মিথ্যা বলতেও দ্বিধাবোধ করে না। এছাড়া সেই মা এটাও লক্ষ্য করলেন তার সাত বছরের ছেলে সমত্মানটি পিঁপড়ার মতো ক্ষুদ্র প্রাণীগুলোকে এমনভাবে পা দিয়ে পৃষ্ঠ করে যেন সে তাদের থেকে প্রতিশোধ নিচ্ছে।
এ সমস্যাটি সমাধান করার জন্য সেই মা একটি বইয়ের দোকানে গেলেন এবং উদারতা, পরোপকারিতা ও প্রাণীর প্রতি দয়া প্রদর্শন শিক্ষা দেয় এমন কিছু গল্পের বই কিনে নিয়ে আসলেন।
কিছুদিন পর তাদের মা এর ফলাফল এভাবে বর্ণনা করলেন,
‘‘যে গল্পটি শিশুদের সচেতনতার উপর প্রভাব ফেলেছিল তা ছিল একটি অন্ধ বিড়ালের। গল্পটি ছিল এমন এক বিড়ালের যে গর্ভাবস্থায় তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিল। যখন সে ছানাগুলোকে জন্ম দিল-তাদের যত্ন নিতে এবং তাদেরকে কাছে রাখতে বিড়ালটিকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। সেই মা আরো বললেন, আমি দশ বারের বেশি এই গল্পটি আমার সমত্মানদেরকে বলেছি, প্রত্যেকবারই তাদের কেউ-না কেউ গল্পটি শুনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে।
একদিন খুব সরল মনে তাদের একজন বলল, মা তুমিতো বিড়ালটিকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসতে পারো, যাতে আমরা তার বাচ্চাদের যত্ন নিয়ে তাকে হেল্প করতে পারি।
(৪). সময়কে বই পড়ায় ব্যয় করা বাচ্চাদেরকে টিভি দেখা এবং কম্পিউটার গেইমে আসক্তি থেকে দূরে রাখে, যা বই পড়ার অন্যতম একটি উপকারিতা।
এটা দুঃখজনক যে, অনেক পরিবার মনে করে টিভি বাচ্চাদেরকে ব্যস্ত রেখে বাচ্চাদের উৎপীড়ন থেকে অভিভাবকদের রক্ষা করে এবং বাচ্চারা নিজেদের শারীরিক ক্ষতি থেকেও রক্ষা পায়। তারা দাবি করে যে, টিভি তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে থাকতে সহায়তা করে এবং তাদেরকে শান্ত রাখে। কিন্তু এগুলো সবই হলো ভুল ধারণা-শিশুদের ক্ষক্ষত্রে টিভি এর ভূমিকা সম্পর্কে।
এটা সত্য যে, বিনোদনের একটা বড় মাধ্যম টিভি, কিন্তু শিশুদের মনে টিভি যে খারাপ ধারণা এবং মূল্যবোধ প্রবেশ করিয়ে দেয় তা কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই পরিবারের উপর দায়িত্ব হলো শিশুদের টিভি দেখার সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া। শিশুর বয়স যত বেশি হবে, তার টিভি দেখার সময়ও তত সীমিত করে দেওয়া উচিত।
এক বাবা তার বাচ্চাদের ব্যাপারে বলেন, আমি লক্ষ্য করলাম, আমার ছেলে ও মেয়ে উভয়ই টিভি দেখার ব্যাপারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করে। এটা তাদের আসক্তির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। তাই আমি যা করলাম তা হলো, দুই সপ্তাহের জন্য টিভির সুইচ বন্ধ করে দিলাম। এতে তারা অংক, বই পড়া এবং বুদ্ধিবৃত্তিক গেম এর দিকে ঝুঁকে পড়ল।
পরবর্তীতে যখন আমি তাদেরকে টিভি অন করতে দিলাম, তারা এর প্রোগ্রামগুলোর প্রতি পূর্বের তুলনায় কম আগ্রহ দেখালো। তারা পড়ার প্রতিই বেশি বেশি আগ্রহ দেখাতো। তাই শিশুদের পিতা-মাতাগণ ধারণাটি প্রয়োগ করতে পারেন।
শিশুদের বই পড়ার প্রতি ভালোবাসার উপকারিতা এবং সুবিধা সত্যিই অগণিত। পড়ার প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করার জন্য আমাদের নিজেদের ভেতর বড় ধরনের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। প্রাথমিক কিছু পদক্ষক্ষপ গ্রহণ ছাড়া এটা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কারণ মূল্যবান সময়ের অনেকটাই ইতিমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই চলুন আর সময় নষ্ট না করি।
আমি এই অধ্যায়টি বিখ্যাত একজন স্কলার আব্দুল আযীয বিন বায রাহিমাহুল্লাহর একটি কথা দিয়ে শেষ করব। তিনি একদিন বলেছিলেন :
‘‘নিশ্চয়ই পড়ার প্রতি ভালোবাসা বিচার দিবসের পূর্বেই মুমিনদের জন্য আল্লাহর দেওয়া অগ্রিম পুরস্কার। আলহামদুলিল্লাহ।
Reviews
There are no reviews yet.