বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায

৳ 36

বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায
লেখক :আব্দুল হামীদ ফাইযী আল মাদানী
প্রকাশনী : তাওহীদ পাবলিকেশন্স
বিষয় : সালাত/নামায; ফিকহ ও ফাতাওয়া-মাসায়েল
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৮৪; কাভার: পেপার ব্যাক
Description

বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায

বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায
প্রকাশনী : তাওহীদ পাবলিকেশন্স
বিষয় : সালাত/নামায; ফিকহ ও ফাতাওয়া-মাসায়েল
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৮৪; কাভার: পেপার ব্যাক
বইটি কিনতে কিল্ক করুন: বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায
আরো জানতে কিল্ক করুন: তাওহীদ পাবলিকেশন্স

বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায

বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায

প্রণয়নে

আব্দুল হামীদ ফাইযী আল-মাদানী

বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ইসলামী গবেষক, লেখক, মুহাক্কিক আলিম ও দাঈ

প্রকাশনায়

তাওহীদ পাবলিকেশন্স

ঢাকা-বাংলাদেশ


বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায

সূচীপত্র

  • ভূমিকা
  • প্রথম অধ্যায়
  • ফরয নামাযের পর হাত তুলে মনাাজাত কি বিদআত?
  • দ্বিতীয় অধ্যায়
  • ফরয নামাযের পর হাত তুলে মনাাজাতের প্রমাণ ও তার খণ্ডণ
  • ফাযায়েলে আ’মালে যয়ীফ হাদীসের ব্যবহার
  • আরো কিছু ফতোয়া ও যুক্তি
  • জামাআতী মুনাজাতের প্রমাণ
  • অপবাদ ও তার অপনোদন
  • তৃতীয় অধ্যায়
  • মাগরেবের পূর্বে দুই রাকআত নামায কি বিদআত?

বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায

বই পড়ুন, আপনজনকে

পড়তে দিন।

আল-কুরআনের প্রথম

আদেশ অবতীর্ণ হয়,

‘তুমি পড়।’

সুতরাং পড়ুন, আমল

করুন, অপরকে উপদেশ

দিন এবং এ সবে ধৈর্যধারণ


বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায

ভূমিকা
الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على أشرف المرسلين، نبينا محمد وعلى اله وصحبه أجمعين. وبعد

বিদআতের বিরুদ্ধে এ্যান্টি-ভাইরাস ভ্যাকসিন নেওয়া সত্ত্বেও সমাজে বিদআতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যা সুন্নত বলে জ্ঞান ছিল, আজ তা বিদআত বলে জানা যাচ্ছে। ইন্টারনেট ও বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সুবিধা হওয়ার ফলে এবং সেই সাথে প্রবাসী কর্মচারী ও হাজী সাহেবদের মাধ্যমে সারা বিশ্বে সঊদী আরবের সাথে দ্বীনী ব্যাপারে যে সামঞ্জস্য বজায় রাখার বিপ্লব শুরু হয়েছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।

সকলের মনে প্রশক্ম, এটা আমাদের দেশে আছে, এখানে নেই কেন? ওটা আমাদের দেশে নেই, এখানে আছে কেন? এই প্রশেক্মর উত্তর খোঁজেন জ্ঞানীগণ। উদারপন্থীগণ সঊদী আরবের ফতোয়া মেনে নেন এবং গোঁড়াপন্থীগণ তা প্রত্যাখ্যান করেন।

ফরয নামাযের পর হাত তুলে মুনাজাত এবং মাগরেবের ফরয নামাযের আগে দুই রাকআত নামাযের মাসআলা দুটিও অনেকের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। অনেক প্রবাসী ও হাজী সাহেবান প্রশেক্মর উত্তর জেনে সঊদী আরবের দ্বীনী জ্ঞান-গবেষণা ও সেখানকার মুফতীদেরকে প্রাধান্য দেন। পক্ষান্তরে অন্য অনেকে তা অগ্রাহ্য করেন, তাঁরা তাঁদের ইজতিহাদী-জ্ঞানে কুরআন-হাদীস থেকে দলীল খুঁজে স্বমতকে বলিষ্ঠ করার চেষ্টা করেন। তাঁরা তাহক্বীক্বের যুগে তাহক্বীক্বকে, তাসহীহ ও তাযয়ীফকে পরোয়া করেন না। ফলে তাঁরা প্রাচীন ইল্মী তাহক্বীক্বের বাহুবলে নিজেদের মতের সমর্থনে লিফলেট ও পুস্তিকা লিখেন এবং সমর্থকরা তা ছেপে বিতরণ করেন। দ্বিধা-দ্ব্েবদ্ব ও সমস্যার ছন্দে পড়েন আম জনসাধারণ।

যাঁদের দৃঢ বিশ্বাস যে, সঊদী আরব তথা আল্লামা আলবানীর ফতোয়া দুর্বল হতে পারে না। অন্ততঃপক্ষে দুই মতের মধ্যে বলিষ্ঠতর মত তাঁদেরই হবে, তাঁরা আমাকে অনুরোধ করেন কিছু লিখার জন্য। অবশ্য অনেকে এ বিষয়ে ফালতু সময় নষ্ট করতে নিষেধও করেন। তবুও ‘বললে মা মার খায়, না বললে বাবা বিড়াল খায়’-এর মত সমস্যায় পড়েও কেবল অপবাদ অপনোদনের উদ্দেশ্যে লিখতে শুরু করলাম।

এ লিখাতে কাউকে তুচ্ছজ্ঞান করা উদ্দেশ্য আমার নয়, বিদ্যা ফলানোও নয়। একমাত্র উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সেই সাথে সমাজের সংস্কার সাধন।
আশা করি, এর দ্বারা উক্ত বিষয় দুটির ব্যাপারে সালাফী সমাজ অনেক আলো পাবে। তা জানার সাথে সাথে আরো অনেক কিছু জানতে পারবে, ইন শাআল্লাহ।
পরিশেষে আল্লাহর কাছে দুআ করি,

اللهم أرنا الحق حقًا وارزقنا اتباعه، وأرنا الباطل باطلًا وارزقنا اجتنابه، {رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ولِإِخْوانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ ولَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَؤُوفٌ رَّحِيمٌ} اللهم آمين.

বিনীত
আব্দুল হামীদ মাদানী
আল-মাজমাআহ
সঊদী আরব


বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায

প্রথম অধ্যায়

ফরয নামাযের পর হাত তুলে মুনাজাত কি বিদআত?
(এটি ‘স্বালাতে মুবাশ্শির’-এর একটি পরিচ্ছেদ)

নামাযী যখন নামায পড়ে তখন সে আল্লাহর নিকট মুনাজাত করে। আল্লাহর সাথে নিরালায় যেন কানে কানে কথা বলে।

নামাযের মাঝেই আব্দ্ (দাস) মাবুদের (প্রভুর) ধ্যানে ধ্যানমগ্ন থাকে। যেন সে তাঁকে দেখতে পায়। যতক্ষণ সে নামাযে থাকে ততক্ষণ সে আল্লাহর সাথে কথা বলে। তিনি তার প্রতি মুখ ফিরান এবং সালাম না ফিরা পর্যন্ত তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন না।

পরক্ষণে যখনই সে সালাম ফিরে দেয় তখনই সে মুনাজাতের অবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, দূর হয়ে যায় নৈকট্যের বিশেষ যোগসূত্র। বান্দা সরে আসে সেই মহান বিশ্বাধিপতির খাস দরবার থেকে। সুতরাং তার নিকট কিছু চাওয়া তো সেই সময়ে অধিক শোভনীয় যে সময়ে ভিখারী বান্দা তাঁর ধ্যানে তার নিকটে ও তাঁর খাস দরবারে থাকে। অতএব সেই নৈকট্যের ধ্যান ভগ্ন করে এবং মহানবী (স) এর নির্দেশিত মুনাজাত থেকে বেরিয়ে এসে পুনরায় মুনাজাত সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত নয়।

অবশ্য সহীহ হাদীসে বর্ণিত যে, একদা সাহাবাগণ আল্লাহর রসূল (স) কে কোন্ সময় দুআ অধিকরূপে কবুল হয় – সে বিষয়ে প্রশক্ম করলে তিনি বলেছিলেন, “গভীর রাতের শেষাংশে এবং সকল ফরয নামাযের পশ্চাতে। হাদীসটি অনেকের নিকট দুর্বল হলেও আসলে তা হাসান।

সুতরাং এটাই হচ্ছে ফরয নামাযের পর মুনাজাত করার প্রায় সহীহ ও সব চেয়ে বড় দলীল, যদিও এতে হাত তুলে জামাআত সহকারে দুআর কথা নেই। এইখান হতেই ধোকা খেয়ে মুনাজাত-প্রেমীরা উদ্ভাবন করেছেন যে, ‘ফরয নামাযের পর দুআ কবুল হয়। আর হাত তুলে দুআ করলে আল্লাহ খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না। তাছাড়া নামাযের পর লোক ও জামাআত বেশী থাকে। আর জামাআতী দুআ বেশী কবুল হয়।’ ইত্যাদি।

বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায

পক্ষান্তরে আযানের সময়, আযান ও ইকামতের মাঝে, ইকামতের সময়, বৃষ্টি বর্ষণের সময় ও আরো যে সব সময়ে দুআ কবুল হয় সে সব সময়ে কৈ জামাআতী দুআ নজরে পড়ে না। অভ্যাসে পরিণত হয়েছে কেবল ফরয নামাযের পর দুআ।

শুরুতে একটা কথা খেয়াল রাখা উচিত যে, ইবাদত যখন, যেভাবে, যে গুণ, সংখ্যা ও পদ্ধতিতে বিধিবদ্ধ হয়েছে প্রত্যেকটি ইবাদত সেই গুণ, পদ্ধতি, সংখ্যা ও সময় অনুসারে করা জরুরী। অনির্দিষ্ট বা সাধারণ থাকলে তা কোন গুণ দ্বারা নির্দিষ্ট করা বিদআতের পর্যায়ভুক্ত।

সুতরাং দুআর এক সাধারণ নিয়ম হল, হাত তুলে দুআ করা। অর্থাৎ কেউ নিজ প্রয়োজনে সাধারণ সময়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনাম করলে হাত তুলে করবে। এখন যদি কেউ বলে, ‘আমি আমার প্রয়োজন নামাযে চাই বা না চাই, নামাযের পরে রসূলের বা নিজের ভাষায় হাত তুলে চাইব’- তাহলে তার প্রথমে জানা উচিত যে, নামাযের পর একটি নির্দিষ্ট সময়। আর তাতে রয়েছে নির্দিষ্ট ইবাদত (যিকর-আযকার)। অতএব ঐ নির্দিষ্ট সময়ে শরীয়ত কি করতে নির্দেশ করেছে? যা করতে নির্দেশ করেছে তার নিয়ম কি? ইত্যাদি। এই ক্ষেত্রে অনুরূপ সাধারণ নিয়ম সংযোজন করা যাবে না। করলেই তা অতিরঞ্জন তথা বিদআত রূপে পরিগণিত হবে। ফলকথা, তাকে দেখতে হবে যে, ঐ নির্দিষ্ট ইবাদতের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্টরূপে দুআ বা মুনাজাতের নির্দেশ শরীয়তে আছে কি? নচেৎ আল্লাহর রসূল (স) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাদের এ (শরীয়তের) ব্যাপারে নতুন কিছু উদ্ভাবন করে যা ওর অন্তর্ভুক্ত নয় তা প্রত্যাখ্যাত।” “যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করে যার উপর আমাদের কোন নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত।”
এবার প্রশক্ম থাকছে উপরোক্ত হাদীস মুনাজাতের স্বপক্ষে দলীল কি না? উক্ত হাদীসে যে ‘দুবুর’ শব্দ ব্যবহার হয়েছে তার অর্থ হল, পিঠ, পাছা, পশ্চাৎ বা শেষাংশ। যাঁদের অর্থে ‘দুবুর’ মানে ‘পরে’, তাঁদের মতে এই হাদীসটি ফরয নামাযের পর দুআ বা মুনাজাতের বড় দলীল। (যদিও হাত তুলে ও জামাআত করে নয়।) কিন্তু উক্ত হাদীসে ‘দুবুর’ শব্দের অর্থ পরে করা ঠিক কি?

বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায

এখন যদি বলি, ‘গরুর দুবুর (পাছা)’, তাহলে শ্রোতা এই বুঝবে যে, গরুর পাছা দেহের অবিচ্ছেদ্য পিছনের অঙ্গ। তার দেহাংশের বাইরের কিছু নয়। সুতরাং নামাযের দুবুর, বা পাছা অথবা পশ্চাৎ বলতে বুঝা দরকার যে, তা নামাযেরই শেষ অঙ্গ বা অংশ। নামাযের বাইরের কিছু নয়; অর্থাৎ সালাম ফিরার পূর্বের অংশ।

অবশ্য ‘দুবুর’ (পশ্চাৎ) বলে পরের অংশকেও বুঝানো যায়। যেমন যদি বলি, ‘ইমাম সাহেব বাসের দুবুরে (পশ্চাতে বা পেছনে) দাঁড়িয়ে আছেন।’ তাহলে ইমাম সাহেবকে যে দেখেনি সে শ্রোতা দুই রকম বুঝতে পারে; প্রথমতঃ এই যে, ইমাম সাহেব বাসের পেছনের অংশে বাসের ভিতরেই দাঁড়িয়ে আছেন। আর দ্বিতীয়তঃ এই যে, ইমাম সাহেব বাসের পেছনে রোডে (বাসের বাইরে) দাঁড়িয়ে আছেন। আর এক্ষেত্রে শ্রোতার দুই প্রকার বুঝাই সঠিক, ভুল নয়। কিন্তু ইমাম সাহেবের আসল দাঁড়াবার জায়গা বাস্তবপক্ষে একটাই, বিধায় অপরটি অসম্ভব।

সুতরাং উক্ত হাদীসের অর্থ যদি ‘নামাযের পশ্চাতে অর্থাৎ সালাম ফিরার পূর্বে দুআ কবুল হয়’ বলি, তাহলে একথাও বলতে হয় যে, ‘সালাম ফেরার পূর্বেই তসবীহ-তাহলীলও করতে হবে।’ কারণ ওখানেও ‘দুবুর’ শব্দ ব্যবহার হয়েছে। যার অর্থেম উলামাগণ নামাযের পর যিক্র পড়ার কথা বলে থাকেন। অতএব উক্ত দ্ব্যর্থবোধক শব্দের ব্যাখ্যা খুঁজতে আমাদেরকে শরীয়তের সাহায্য নিতে হবে। যেহেতু মহানবী (স) এর এক উক্তিকে তাঁর অপর উক্তি বা আমল ব্যাখ্যা করে। চলুন এবারে আমরা তাই দেখে ‘দুবুর’ এর সঠিক অর্থ নির্ধারণ করি।

সালাম ফেরার পরে কি করা উচিত সে ব্যাপারে আল্লাহর এক নির্দেশ হল, “অতঃপর যখন তোমরা নামায সমাপ্ত করবে তখন আল্লাহর যিক্র কর—-।” “তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর রাত্রির একাংশে এবং নামাযের পরেও।” তাই তো আল্লাহর নবী (স) এর আমল ও অভ্যাস ছিল সালাম ফিরার পর আল্লাহর যিক্র করা।

হযরত আয়েশা (র:) বলেন, আল্লাহর রসূল (স) “আল্লা-হুম্মা আন্তাস সালাম— ” বলার মত সময়ের চেয়ে অধিক সময় সালাম ফেরার পর বসতেন না।

বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায

সাওবান (র:) বলেন, আল্লাহর রসূল (স) যখন নামায শেষ করতেন তখন তিনবার ইস্তিগফার করে “আল্ল-হুম্মা আন্তাস সালাম—- ” বলতেন।

আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (র:) বলেন, আল্লাহর রসূল (স) যখন সালাম ফিরতেন তখন উঁচু শব্দে বলতেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হু অহদাহু —।” (এ ব্যাপারে ফরয নামাযের পর যিক্রের আলোচনা দেখুন।)

সালাম ফিরা হলে তিনি মহিলাদের জন্য একটু অপেক্ষা করতেন, যাতে তারা পুরুষদের আগেই মসজিদ ত্যাগ করতে পারে। অতঃপর তিনি উঠে যেতেন।

সামুরাহ বিন জুনদুব < বলেন, ফজরের নামায শেষ করে আল্লাহর নবী (স) আমাদের দিকে ফিরে বসে বলতেন, “গত রাত্রে তোমাদের মধ্যে কে স্বপক্ম দেখেছে?” অতঃপর কেউ দেখলে সে বর্ণনা করত। নচেৎ তিনি নিজে স্বপক্ম দেখে থাকলে তা বর্ণনা করতেন।

অবশ্য একদা কা’বা শরীফের নিকট মহানবী (স) এর নামায পড়া কালে কুরাইশের দুষ্কৃতীরা তাঁর সিজদারত অবস্থায় ঘাড়ে উঁটনীর (গর্ভাশয়) ফুল চাপিয়ে দিলে হযরত ফাতেমা (র:)খবর পেয়ে ছুটে এসে তা সরিয়ে ফেলেন। এহেন দুর্ব্যবহারের ফলে আল্লাহর রসূল (স) নামায শেষ করে উচ্চস্বরে ঐ দৃষ্কৃতীদের জন্য বদ্দুআ করেন এবং তা কবুলও হয়ে যায়।

কিন্তু সে নামায ফরয ছিল না নফল, তা নিশ্চিত নয়। পরন্তু এতে হাত তোলার কথা নেই। তাছাড়া এটি ছিল তাৎক্ষণিক বদ্দুআ; যা তাদেরকে শুনিয়ে করা হয়েছিল।

আর একটি সহীহ হাদীসে এসেছে যে, তিনি ফজরের নামাযে সালাম ফিরে বলতেন, “আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকা ইলমান না-ফিআউঁ অরিযকান ত্বাইয়িবাঁউ অআমালাম মুতাক্বাব্বালা।” (অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট অবশ্যই ফলপ্রসূ জ্ঞান, উত্তম রুযী এবং কবুলযোগ্য আমল প্রার্থনা করছি।

বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায

অন্য এক হাদীসে তিনি বলতেন, ‘রাব্বি ক্বিনী আযা-বাকা ইয়াওমা তাবআষু (অথবা তাজমাউ) ইবা-দাক।’ হে আমার প্রভু! তুমি আমাকে তোমার সেই দিনের আযাব থেকে বাঁচায়ো, যেদিন তুমি স্বীয় বান্দাদেরকে কবর থেকে উঠাবে কিংবা হিসাবের জন্য জমা করবে।
অবশ্য এখানেও হাত তোলার কথা নেই।

সুতরাং বলা যায় যে, সালাম ফিরার পর আল্লাহর নবী (স) অধিকাংশ সময়ে আল্লাহর যিক্র পড়েছেন। আর কখনো কখনো তিনি ফজরের পর ঐ দুআ (হাত না তুলে) পাঠ করেছেন।

পক্ষান্তরে সালামের পূর্বে তিনি (প্রার্থনামূলক) দুআ পড়তে আদেশ দিয়ে বলেন, “এরপর (তাশাহহুদের পর) তোমাদের যার যা ইচ্ছা ও পছন্দ সেই মত দুআ বেছে নিয়ে দুআ করা উচিত।”

“যখন তোমাদের মধ্যে কেউ (শেষ) তাশাহহুদ সম্পন্ন করবে তখন সে যেন আল্লাহর নিকট চারটি জিনিস থেকে পানাহ চায়; জাহান্নামের আযাব, কবরের আযাব, দাজ্জালের ফিতনা এবং জীবন ও মৃত্যুর ফিতনা থেকে। এরপর সে ইচ্ছামত দুআ করবে।”

সালাম ফিরার পূর্বে তাশাহহুদের পর তিনি নিজেও বিবিধ প্রকার দুআ পড়ে প্রার্থনা করেছেন। (দুআয়ে মাসুরা দ্রষ্টব্য) এমন কি উক্ত চার প্রকার আযাব ও ফিতনা হতে পানাহ চাওয়ার দুআ আল্লাহর নবী (স) কুরআন কারীমের সূরা শিখানোর মত সাহাবাগণকে শিক্ষা দিতেন। তাই তো ৩ অথবা ৪ জন সাহাবী হতে উক্ত দুআর হাদীস বর্ণনাকারী তাবেয়ী ত্বাউস একদা তাঁর ছেলেকে বললেন, ‘তুমি তোমার নামাযে ঐ দুআ পড়েছ কি? বলল, না। তিনি বললেন তাহলে তুমি তোমার নামায ফিরিয়ে পড়।’
কেননা, তাঁর নিকট উক্ত দুআর এত গুরুত্ব ছিল যে, তিনি মনে করতেন, যে দুআ পড়তে আল্লাহর নবীর আদেশ, আমল ও শিক্ষা রয়েছে তা না পড়লে নামাযই হবে না!
একদা আল্লাহর রসূল (স) (মসজিদে) বসে ছিলেন, এমন সময় এক ব্যক্তি প্রবেশ করে নামায শুরু করল। (নামাযে) সে বলল, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর, আমার প্রতি দয়া কর।’ তা শুনে আল্লাহর রসূল (স) বললেন, “তাড়াহুড়ো করলে তুমি হে নামাযী! যখন তুমি নামাযে বসবে তখন আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রসংশা কর এবং আমার উপর দরূদ পড়, তারপর আল্লাহর নিকট দুআ কর।”

কিছুক্ষণ পরে আর এক ব্যক্তি নামায পড়তে শুরু করল, সে আল্লাহর প্রশংসা করে নবী (স) এর উপর দরূদ পাঠ করল। তখন তা শুনে তিনি বললেন, “হে নামাযী! (এবার তুমি) দুআ কর, কবুল হবে ।”

ইবনে মসউদ (র:) বলেন, ‘একদা আমি নামায পড়ছিলাম, আর নবী (স), আবু বাক্র ও উমার (র:) (পাশেই বসে) ছিলেন। যখন আমি বসলাম তখন আল্লাহর প্রশংসা ও দরূদ শুরু করলাম। তারপর আমি নিজের জন্য দুআ করলাম। তা শুনে নবী (স) বললেন, “তুমি চাও, তোমাকে দান করা হবে, তুমি চাও, তোমাকে দান করা হবে।”
আর আল্লাহর রসূল (স) বলেন, “তোমাদের কেউ যখন নামাযে দাঁড়ায় সে তখন তার রবের সাথে মুনাজাত করে। অতএব মুনাজাতে সে কি বলে, তা তার জানা উচিত। অতএব সঠিক মুনাজাতের স্থান ও দুআ কবুল হওয়ার সময় সালাম ফিরার পূর্বে নয় কি?

পরন্তু যদি ‘দুবুর’ শব্দের অর্থ ‘পরে’ ধরে নেওয়া যায় তবুও তাতে হাত তুলে মুনাজাত প্রমাণ হয় না। আর এখানে হাত তুলে দুআ করা দুআর আদব বলে এবং আল্লাহ (হাত তুলে দুআ করলে) খালি হাত ফিরিয়ে দেন না বলে এখানেও তোলা হবে বা তুলতে হবে, তা বলা যায় না। ঐ দেখুন না, জুমআর খুতবায় দুআ বিধেয়। নবী (স) বৃষ্টির জন্য হাত তুলে খুতবায় দুআও করেছেন। কিন্তু সাধারণ সময়ে খুতবায় তিনি হাত তুলতেন না। তাইতো উমারাহ বিন রুয়াইবাহ যখন বিশ্র বিন মারওয়ানকে জুমআর খুতবায় হাত তুলে দুআ করতে দেখলেন, তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ঐ হাত দুটিকে বিকৃত করুক! আমি আল্লাহর রসূল (স)-কে কেবল তাঁর আঙ্গুল দ্বারা এভাবে ইশারা করতে দেখেছি।

সুতরাং হাত তুলে দুআর আদব হলেও যেহেতু ঐ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ে তিনি হাত তুলেন নি, তাই সলফগণ তা বৈধ মনে করতেন না। যুহরী বলেন, ‘জুমআর দিন হাত তোলা নতুন আমল (বিদআত)।’ ত্বাউস জুমআর দিন হাত তুলে দুআকে অপছন্দ করতেন এবং তিনি নিজেও হাত তুলতেন না।
ইমাম ও মুক্তাদীগণের খুতবায় হাত তুলে দুআ প্রসঙ্গে মাসরূক বলেন, (যারা ঐভাবে দুআ করে) ‘আল্লাহ তাদের হাত কেটে নিক।’

সুতরাং একথা স্পষ্ট হল যে, ফরয নামাযের পর দুআ বৈধ ধরা গেলেও হাত তুলে দুআর আদব বলে হাত তোলা এখানেও বিদআত হবে, যেমন জুমআর খুতবায় হবে। কারণ নামাযের পরে মহানবী (স) এর আদর্শ ও তরীকা আমাদের সামনে মজুদ।

এ তো গেল একাকী হাত তুলে মুনাজাতের কথা। অর্থাৎ একাকী নামাযীর জন্যও বিধেয় নয় ফরয নামাযের পর হাত তুলে মুনাজাত করা ।
বাকী থাকল জামাআতী দুআর কথা, তো তার প্রমাণ আরো দুঃসাধ্য। যাঁরা করেন বা করা ভালো মনে করেন তাঁরা বলেন, যে, ‘জামাআতের দুআ একটি সুবর্ণ সুযোগ।’ এর প্রমাণে তাঁরা এই যুক্তি পেশ করেন যে, ‘জামাআতে দুআ করলে দুআ কবুল হয়। একাকী অনেকের দুআ কবুল নাও হতে পারে। সুতরাং পাঁচজন ভালো লোকের ফাঁকে একজন মন্দলোকেরও দুআ কবুল হয়ে যায়!’ তাঁরা আরো বলেন, ‘কোন নেতার কাছে কোন দাবী বা আবেদনের ব্যাপারে একার চেয়ে যৌথ ও জামাআতী চেষ্টাতেই কৃতার্থ হওয়া অধিক সম্ভব।’ ইত্যাদি।

কিন্তু প্রথমতঃ যুক্তিটি দলীল-সাপেক্ষ। দ্বিতীয়তঃ দুনিয়ার ভীতু নেতাদের সাথে সার্বভৌম ক্ষমতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার অধিকারী মহান আল্লাহকে তুলনা করা বেজায় ভুল ও হারাম।

পরন্তু যদি তাই হয়, তবে এ যুক্তি ও সুযোগের কথা মহানবী (স) এবং তাঁর সাহাবাগণ কি জানতেন না? নাকি তাঁদের চেয়ে ওঁরা বেশী জানলেন? কই তাঁরা তো এই সুযোগ গ্রহণ করে অনুরূপ জামাআতী দুআ ফরয নামাযের পর করে গেলেন না?

বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায

পরন্তু তাঁরাও জামাআতী কল্যাণে জামাআতবদ্ধভাবে দুআ করেছেন; বিপদ-আপদের সময় ফরয নামাযের শেষ রাকআতে রুকু থেকে উঠার পর কওমায় হাত তুলে মুসলিমদের জন্য জামাআতী দুআ ও কাফেরদের জন্য বদ্দুআ করেছেন।

সাহাবাগণ রমযানের বিত্র নামাযে রুকুর পূর্বে বা পরে হাত তুলে জামাআতী দুআ করেছেন।

তাঁরা নামাযের ভিতরেই হাত তুলে জামাআতী দুআ করেছেন। কিন্তু নামাযের পর করা উত্তম হলে তা করতেন না কি? আর প্রত্যহ পাঁচ-অক্ত নামাযে তা করে থাকলে কোন একটি সহীহ হাদীসে তার বর্ণনা আসত না কি?

একদা মহানবী (স) জুমআর খুতবা দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক মরুবাসী (বেদুঈন) উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! মাল-ধন ধ্বংস হয়ে গেল, আর পরিবার-পরিজন (খাদ্যের অভাবে) ক্ষুধার্ত থেকে গেল। সুতরাং আপনি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করুন।’ তখন মহানবী (স) নিজের দুই হাত তুলে দুআ করলেন। ফলে এমন বৃষ্টি শুরু হল যে পরবর্তী জুমআতে উক্ত (বা অন্য এক) ব্যক্তি পুনরায় খাড়া হয়ে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! ঘর-বাড়ি ভেঙে গেল এবং মাল-ধন ডুবে গেল। সুতরাং আপনি আমাদের জন্য দুআ করুন!’ মহানবী (স) তখন তিনি নিজের হাত তুলে পুনরায় বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার জন্য দুআ করলেন এবং বৃষ্টিও গেল থেমে।
অতএব বুঝা গেল যে, নামাযের পর দুআর অভ্যাস ছিল না বলেই উক্ত সাহাবী যে সময় কথা বলা এবং কেউ কথা বললে তাকে চুপ করতে বলাও নিষিদ্ধ সেই সময় আল্লাহর নবী (স) কে দু’ দু’বার দুআর আবেদন জানালেন।

সায়েব বিন য়্যাযীদ বলেন, একদা আমি মুআবিয়া (র) এর সাথে (মসজিদের) আমীর-কক্ষে জুমআর নামায পড়লাম। তিনি সালাম ফিরলে আমি উঠে সেই জায়গাতেই সুন্নত পড়ে নিলাম। অতঃপর তিনি (বাসায়) প্রবেশ করলে একজনের মারফৎ আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘তুমি যা করলে তা আর দ্বিতীয়বার করো না। জুমআর নামায সমাপ্ত করলে কথা বলা অথবা বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তার সাথে আর অন্য কোন নামায মিলিয়ে পড়ো না। কারণ, আল্লাহর রসূল (স) আমাদেরকে আদেশ করেছেন যে, (মাঝে) কথা না বলে বা বের হয়ে না গিয়ে কোন নামাযকে যেন অন্য নামাযের সাথে মিলিয়ে না পড়ি।’

উক্ত হাদীস নিয়ে একটু চিন্তা করলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, সাহাবাদের যুগেও ঐ মুনাজাতের ঘটা বিদ্যমান ছিল না। সুতরাং তা যে নব-আবিষ্কৃত বিদ্আত তা পরিষ্কার হয়ে যায়।
কিন্তু অজান্তে লোকেরা শাঁস ছেড়ে আঁটিতে কামড় মারছে! যেখানে দুআ করা ওয়াজিব বা বিধেয় সেখানে না করে অসময় ও অবিধেয় স্থানে দুআ করার জন্য মারামারি! আবার কেউ না করলে তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি!! কিন্তু তাও কি বৈধ?

অতএব আপনি যদি জ্ঞান ও বিবেকের সাহায্যে শরীয়তের মাপকাঠিতে ইনসাফ করতে চান এবং দ্বিধাবিভক্ত সমাজের সংকীর্ণ মনের মানুষদের হূদয়-দ্বারকে উদার ও উন্মুক্ত করে শৃঙ্খলা আনতে চান, তাহলে নিশ্চয় এ ব্যাপারে আসল সত্য আপনার নিকটও প্রকট হয়ে উঠবে ইন শা-আল্লাহ। পক্ষান্তরে আপনি তো চান আল্লাহর অনুগ্রহ, আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত। তবে তা যদি এ সময় ছাড়া অন্য সময়েই পাওয়া যায়, তাহলে তা সে সময়েই চেয়ে নিতে বাধা কোথায়? কথায় বলে, “ঢেঁকিশালে যদি মানিক পাই, তবে কেন পর্বতে যাই?” মোট কথা আপনার প্রয়োজন আপনি আপনার নামাযেই ভিক্ষা করুন। আপনার আপদে-বিপদে ও বালা-মসীবতে নামাযেই সাহায্য প্রার্থনা করুন। বিশেষ করে আল্লাহ যেহেতু বলেন, “তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর।”

মহানবী (স) বলেন, “জুমআর দিনে এমন একটি (সামান্য) মুহূর্ত আছে, যদি কোন মুসলিম বান্দা নামায পড়া অবস্থায় তা পায় এবং আল্লাহর নিকট কোন মঙ্গল প্রার্থনা করে, তাহলে আল্লাহ তাকে তা দিয়ে থাকেন।”

বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায

বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায

Reviews (0)

Reviews

There are no reviews yet.

Be the first to review “বিতর্কিত মুনাজাত ও একটি নামায”

Your email address will not be published.

Shopping cart
Facebook Twitter Instagram YouTube WhatsApp WhatsApp

Sign in

No account yet?