যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৩য় খন্ড

৳ 230

যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৩য় খন্ড
লেখক: আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলাবানী (রহ.)
প্রকাশনায়: তাওহীদ পাবলিকেশন্স
বিষয়: হাদিস, হাদিস বিষয়ক আলোচনা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৬২৪

Description

যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৩য় খন্ড

যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৩য় খন্ড
লেখক: আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলাবানী (রহ.)
প্রকাশনায়: তাওহীদ পাবলিকেশন্স
বিষয়: হাদিস, হাদিস বিষয়ক আলোচনা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৬২৪
বইটি কিনতে কিল্ক করুন: যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৩য় খন্ড
আরো জানতে কিল্ক করুন: তাওহীদ পাবলিকেশন্স

উম্মাতের মাঝে জাল ও যইফ হাদীছ এর কুপ্রভাব দূর করতে মুহাদ্দিসগণের প্ররিশ্রমের অন্ত নেই। আল্লাহর এই ওয়াহী সংরক্ষণ করতে তাঁরা পরিশ্রম করেছেন। তারা ছহীহ ও যঈফ হাদিস গুলোকে আলাদা করে আমাদের মাঝে তুলে ধরেছেন যাতে আমরা যঈফ হাদিসের উপর আমল করে বিভ্রান্ত না হই। এছাড়া যেন আমরা ছহীহ হাদীছের উপর আমল করতে পারি। এরকমই একজন গত শতাব্দীর অন্যতম সেরা মুহাদ্দিস শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.)। তিনি যঈফ ও জাল হাদীছ সিরিজ নিয়ে “সিলসিলাতুল যঈফাহ ওয়াল মাউযুআহ’ নামে হাদীছ সিরিজ লিখেছেন। যার বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

বইটির বৈশিষ্ট্য:
● যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৩য় খন্ড বইটির শুরুতেই হাদীছ সংকলন ও সংরক্ষণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে।
● যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৩য় খন্ড গ্রন্থটির তাহক্বীক বুঝতে হাদীছের পরিভাষা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
● বিভিন্ন বিষয়ের হাদীছগুলো ছড়িয়ে থাকলে সূচিপত্রে তা বিষয়ভিত্তিক আকারে উল্লেখ করা হয়েছে। সাথে হাদীছটির মানও উল্লেখ করা হয়েছে।
● হাদীছটি কোন গ্রন্থে রয়েছে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
● হাদীছটির বিভিন্ন রাবী সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের উক্তি উল্লেখ সাপেক্ষে শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ)-এর তাহক্বীক উল্লেখ করা হয়েছে।
● কোন হাদীছের অংশবিশেষ ছহীহ হলে তাও উল্লেখ করা হয়েছে। সেটি সিলসিলাহ সহীহাহতে থাকলে তার নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে।
● কোন হাদীছের তাহক্বীক  আলবানী (রহ) পরবর্তীতে পরিবর্তন করলে তাও উল্লেখ করা হয়েছে।

যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৩য় খন্ড

এবং

উম্মাতের মাঝে তার কুপ্রভাব

তৃতীয় খণ্ড

হাদীছ ১০০১-১৫০০

মূলঃ

আল্লামা মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ)

অনুবাদঃ

আবূ শিফা মুহাম্মাদ আকমাল হুসাইন বিন বাদীউযযামান

লীসাপ মাদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সউদী আরব।

এম, এ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।

সম্পাদনাঃ

শাইখ আকরামুজ্জামান বিন আব্দুস সালাম

লীলাপ- মাদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সউদী আরব।

এম এ দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

শাইখ আমানুল্লাহ বিন ইসমা’ঈল

লীসান্স মাদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সউদী আরব।

ইসলাম মানুষের জন্য আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ ও শাশ্বত জীবন বিধান। এতে মানব কল্যাণের যাবতীয় দিক বর্ণিত হয়েছে। ইসলামী জীবনাদর্শের মূল উৎস হ’ল আল্লাহর ‘অহি’ তথা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ। আল্লাহ তা’আলা নিজেই যিক্র তথা অহি-কে হেফাযত করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন,  ‘নিশ্চয় আমরা বিক্র নাযিল করেছি এবং আমরাই তার হেফাযত করব (হিজর ৯)। এই ঘোষণা পূর্বেকার কোন এলাহী কিতাব সম্পর্কে তিনি দেননি। ফলে সেগুলির কোন অস্তিত্ব এখন পৃথিবীতে নেই। অনেকের ধারণা ‘যিকর’ বলে আল্লাহ কেবল কুরআনের হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন, হাদীছের নেননি। একথা ঠিক নয়। কেননা আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেন,  ‘আমরা আপনার নিকটে ‘যি’ নাযিল করেছি, যাতে আপনি লোকদের উদ্দেশ্যে নাযিলকৃত বিষয়গুলি তাদের নিকটে ব্যাখ্যা করে দেন এবং যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে” (নাহল-৪৪)। আর কুরআনের ব্যাখ্যাই হ’ল ‘হাদীছ’। যা রাসূল নিজ ইচ্ছা মোতাবেক বলতেন না, যতক্ষণ না তাঁর নিকটে ‘অহি’ নাযিল হ’ত। যেমন আল্লাহ বলেন,’রাসুল তাঁর ইচ্ছামত কিছু বলেন না, যতক্ষণ না তাঁর নিকটে ‘অহি’ নাযিল হ’ত’ (নাজম ৩-৪)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘জেনে রেখ। আমি কুরআন প্রাপ্ত হয়েছি ও তার ন্যায় আরেকটি বস্তু’ (আবুদাউদ, মিশকাত হা/১৬৩)। সে বস্তুটি নিঃসন্দেহে ‘হাদীছ’, যার অনুসরণ ব্যতীত কেউ মুমিন হ’তে পারবে না। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তোমার প্রভুর শপথ। তারা কখনোই মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়সমূহে তোমাকেই একমাত্র সমাধানকারী হিসাবে গ্রহণ করবে। অতঃপর তোমার দেওয়া ফায়ছালা সম্পর্কে তাদের মনে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ বোধ করবে না এবং অবনত চিত্তে তা গ্রহণ করবে।

অনেকের ধারণা কেবল লেখনীর মাধ্যমেই হেফাযত হয়, স্মৃতির মাধ্যমে নয়। তাদের একথা ঠিক নয়। কেননা প্রাচীন পৃথিবীতে যখন কাগজ ছিল না, তখন শিলালিপি ইত্যাদি ছাড়াও প্রধান মাধ্যম ছিল মানুষের ‘স্মৃতি’। জাহেলী যুগে আরবদের স্মৃতিশক্তির প্রখরতা ছিল কিংবদন্তীর মত। যা আজকালকের মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। শেষনবীকে আরবে প্রেরণের পিছনে সেটাও অন্যতম কারণ হতে পারে। এরপরেও রাসূলের প্রত্যক্ষ নির্দেশে ও ব্যবস্থাপনায় ‘কুরআন’ লিপিবদ্ধ ও সন্নিবেশিত করা হয়েছে। হাদীছ লিখনের কাজও তাঁর নির্দেশে শুরু করা হয়। যদিও ব্যাপকহারে সবাইকে তিনি এ নির্দেশ দেননি। কেননা তাতে কুরআনের সঙ্গে হাদীছ মিলে যাবার সম্ভাবনা থেকে যেত। রাসূলের মৃত্যুর পরে উক্ত সম্ভাবনা তিরোহিত হবার পর ছাহাবীগণ হাদীছ সংগ্রহ ও সংকলনে মনোনিবেশ করেন। খুলাফায়ে রাশেদীন হাদীছ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। খলীফা ওমর বিন আবদুল আযীয় (৯৯-১০১ হিঃ) সর্বপ্রথম ব্যাপকহারে হাদীছ সংগ্রহ, সংকলন ও প্রচার-প্রসারের নিমিত্ত রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি করেন ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফলে বারেজী-শী’আ, কাদারিয়া-মুরজিয়া ইত্যাদি বিদ’আতী ও ভ্রান্ত ফের্কা সমূহের উদ্ভব ঘটলে তাদের মধ্যে নিজেদের দলীয় স্বার্থে হাদীছকে ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা দেয়। ৩৭ হিজরীর পরের যুগে তখনই প্রথম হাদীছ বর্ণনাকারীর দলীয় পরিচয় ও স্বভাব-চরিত্র যাচাইয়ের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। মুহাম্মাদ ইবনু সীরীণ (৩৩-১১০ হিঃ) বলেন, এসময় যদি দেখা যেত যে, বর্ণনাকারী ব্যক্তি ‘আহলে সুন্নাত” দলভুক্ত, তাহ’লে তার বর্ণিত হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত। আর যদি দেখা যেত বিদ’আতী দলভুক্ত, তাহ’লে তার বর্ণিত হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত না (মুকাদ্দামা মুসলিম পৃঃ ১৫)। বলা বাহুল্য, মুসলিম সমাজে প্রচলিত শিরকী আক্বীদা ও বিদ’আতী রসম-রেওয়াজ সমূহের অধিকাংশেরই মূল উৎস হ’ল জাল ও যঈফ হাদীছ সমূহ।

আল্লাহ পাক মানবজাতির কল্যাণে প্রেরিত স্বীয় যি’ তথা সর্বশেষ ‘অহি’ পবিত্র কুরআন ও হাদীছ সমূহকে হেফাযত করার জন্য যুগে যুগে অনন্য প্রতিভাসমূহ সৃষ্টি করেছেন। ছাহাবী ও তাবেঈগণের যুগ শেষে বিস্ময়কর মেধা ও প্রতিভার অধিকারী ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম প্রমুখ কুতুবে সিত্তাহর মুহাদ্দিছগণ ছাড়াও যুগে যুগে হাদীছের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমতে তাঁর বাছাইকৃত কিছু বিদ্বান চিরকাল হাদীছের খিদমত করে গিয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর অতুলনীয় প্রতিভা মুহাম্মাদ নাছেরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) তাঁদের অন্যতম। তিনি ছহীহ ও যঈফ হাদীছের উপর পৃথক গ্রন্থসমূহ সংকলন করেছেন। যার অন্যতম হ’ল যার প্রতি খণ্ডে ৫০০ যঈফ ও মওযূ হাদীছ সংকলিত হয়েছে। এযাবৎ প্রাপ্ত এর ১৪টি খণ্ডের মধ্যে ১ম খণ্ডের বঙ্গানুবাদ করেছে স্নেহাস্পদ আকমাল হুসাইন বিন বাদী উদ্যামান।

বাংলাভাষী মুসলমানদের জন্য এটা ছিল অতীব যরূরী কাজ। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পাদন করে সে জাতির এক মহান খিদমত আঞ্জাম দিয়েছে। আল্লাহ তার এই ফ্লিমত কবুল করুন। আমরা আশা করব সে বাকী গুগুলির অনুবাদের কাজও করবে ও আল্লাহর রহমতে তা প্রকাশিত হবে। ইনশাআল্লাহ এ গ্রন্থের মাধ্যমে মানুষ যঈফ ও জাল হাদীছের অপপ্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে হাদীছের অনুসারী হবে।

তার এ অনুবাদ সুন্দর, সাবলীল ও সহজবোধ্য হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে পাঠকদের উপকারে আসবে। যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৩য় খন্ড গ্রন্থটি সকলের সংগ্রহে রাখার মত। আমি যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৩য় খন্ড গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করি। আমীন।

রাজশাহী ৭ই মার্চ ২০০৪

প্রফেসর ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

সাবেক চেয়ারম্যান, আরবী বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ভূমিকা

বর্তমান সমাজে বহু লোক আছে যারা এমন কিছু কর্ম বা আমল সাওয়াবের উদ্দেশ্যে এবাদাত মনে করে উপকারে আসবে ভেবে করে থাকেন যেগুলোর সমর্থনে কোন সহীহ দলীল পাওয়া যায় না। কিন্তু তাদেরকে যখন এ সম্পর্কে বলা হয়, অবহিত করা হয় তখন তারা নিম্নোক্ত কথাগুলো বলে থাকেন। অতএব আমরা সহীহ্ হাদীস এবং সহীহ দলীলের অনুসরণ না করে বানোয়াট, খুবই দুর্বল ও দুর্বল হাদীস এবং দলীলহীন মতের অনুসরণ করার পেছনে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারি :

(১) দলীল নাই তাতে কী হয়েছে নিষেধ তো করা হয়নি।

(২) আরেক শ্রেণীর লোক আছেন যারা মনে করেন যে, হাদীস দুর্বল বা বানোয়াট হলে কি হবে, হাদীস তো।

(৩) আবার অনেকে আছেন যারা বলে থাকেন যে, আপনারা সব কিছুতেই বিদ’আত বিদ’আত করেন। আপনারা জানেন না যে, এগুলো বিদ’আতে হাসানাহ্ (ভালো বিদ’আত)।

(৪) আরেক শ্রেণীর লোক আছে যারা বলেন যে, তাহলে কি সব বড় বড় আলেমরা ভুল করে আসছেন? বড় বড় মাসজিদে এরূপ এরূপ কর্ম করা হচ্ছে, তারা কি ভুল করছেন? তারা কি বুঝেন না?

(৫) আবার এক শ্রেণীর আলেম আছেন যারা কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে ফাতাওয়া দেয়ার সময় বলে থাকেন যে, শারী’য়াতের মধ্যে এর সমর্থনে কিছু নেই। তবে সামাজিকতার খাতিরে অনেক এলাকায় করা হয়ে থাকে। ফলে সামাজিকতা রক্ষার্থে করা হলে করা যেতে পারে। কিন্তু তিনি ভেবে দেখলেন না যে, সামাজিকতা রক্ষার্থে কোন আমল সাওয়াবের উদ্দেশ্যে করা অথবা নিজে বা মৃত ব্যক্তি এর দ্বারা উপকৃত হবে এ বিশ্বাসে কিছু করাকেই শারীয়াতের পরিভাষায় বিদ’আত বলা হয়েছে। যার পরিণতি জাহান্নাম ।

(৬) আবার এক শ্রেণীর লোক আছেন যারা দলীল ভিত্তিক সমাধান প্রদানকারী আলেমদের সম্পর্কে অন্যদেরকে বলেন : আরে উনি বা উনারা তো ওয়াহাবী, লা-মাযহাবী (মাযহাব মানে না)। তাদের অনুসরণ করা যাবে না। মানুষকে বিভ্রান্ত করার এবং সত্যকে গ্রহণ করা থেকে বিমুখ করার এটিও একটি হাতিয়ার। কোন সন্দেহ নেই ওয়াহাবী বলাটা এক ধরনের গালি। যা দ্বারা বুঝানো হয় যে, এরা নিকৃষ্ট আর খুবই খারাপ প্রকৃতির মানুষ আর এ কারণেই এদের অনুসরণ করা যাবে না।

(৭) আরেক শ্রেণীর লোক এমনকি কিছু আলেমও আছেন যারা কোন প্রকার দলীল-প্রমাণের তোয়াক্কা না করে বলে থাকেন বা অযুহাত দাঁড় করিয়ে থাকেন যে, আপনি যা বলছেন সেটা তো আমাদের মাযহাব নয়। আমাদের মাযহাবে এরূপ নেই। অথচ এ শ্রেণীর লোকও একটু ভেবে দেখেন না যে, আমরা যার অন্ধ অনুসরণ করছি তিনি (ইমাম) নিজেও এরূপ অন্ধ অনুসরণ করেননি। বরং তিনি সহীহ্ দলীলের অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। এ কথা যারা বলেন তাদের উদ্দেশ্যে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হচ্ছে, তাহলে আপনারা মাযহাবের অনুসরণ করতে গিয়ে নাবী (স) এর সহীহ্ হাদীস বা সুন্নাহ্ বিরোধী আমল করাকে জায়েয মনে করছেন? আপনাদের নিকট মাযহাব হচ্ছে রসূল (স) এর সহীহ্ হাদীসের চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ ও বড়। যার ফলে হাদীস ত্যাগ করা যাবে কিন্তু মাযহাব ত্যাগ করা যাবে না! অর্থাৎ যে কোন নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসরণ করা যাবে যদিও সে মাযহাবের সিদ্ধান্ত সহীহ হাদীস বিরোধী হয়। সবারই আল্লাহকে ভয় করা উচিত। এ শ্রেণীর লোক সাথে সাথে আরেকটি কথা বলে থাকেন ইমামগণ জ্ঞান-গরীমায় সর্বাপেক্ষা বড় ছিলেন। এ কারণে আমরা তাদের অনুসরণ করে থাকি। কিন্তু এরূপ কথার মধ্যে অতিভক্তির আলামত সুস্পষ্ট। যা সত্যকে উপেক্ষা করার একটি বুলি মাত্র। কারণ অতিভক্তি যেরূপ নিন্দনীয়, শারীয়াতের দৃষ্টিতে সেরূপ দোষণীয়ও বটে।

আল্লাহ তা’আলা বলেন,

وقُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ غَيْرَ الحَقِّ وَلَا تَتَّبِعُوا أَهْوَاءَ

قَوْمٍ قَدْ ضَلُّوا مِنْ قَبْلُ وَأَضَلُّوا كَثِيرًا وَضَلُّوا عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ)

অর্থাৎ, বল, হে কিতাবধারীগণ! তোমরা তোমাদের দ্বীন সম্বন্ধে অন্যায়ভাবে বাড়াবাড়ি করো না, আর সেই সম্প্রদায়ের খেয়াল খুশির অনুসরণ করো না যারা ইতোপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে, অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে আর সোজা পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। (সূরা মায়েদা : ৭৭)

يا أَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ وَلَا تَقُولُوا عَلَى اللهِ إِلَّا الحق …

অর্থাৎ, ওহে কিতাবধারীগণ! তোমরা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না, আর আল্লাহ সম্বন্ধে সত্য ছাড়া কিছু বলো না…. (সূরা নিসা ৪১৭১)

এ ছাড়া স্বীকার করি আর না করি এরূপ কথা বাতিল ও ভ্রান্ত আকীদার সাথে জড়িত হতে উৎসাহিত করে। যেমন এ ধরনের ইমামের কি ভুল হতে পারে। মানে তিনি যেন নিষ্পাপ ছিলেন। [নাবীদের ন্যায়]। অথচ নাবী ও রসূলগণ ছাড়া অন্য কেউ ভুলের উর্দ্ধে নন। এছাড়া আমরা কি ভেবে দেখেছি, ইমামদের কথাকে সহীহ্ হাদীস বিরোধী হলেও কোন দলীলের ভিত্তিতে অনুসরণীয় বলছি? আর আমরা কি একটু ভেবে দেখেছি আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীর ভাবার্থ সম্পর্কে :

قل إن كُنتُمْ تُحِبُّونَ الله فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ

ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ) (آل عمران: ۳۱)

অর্থাৎ, “বলে দাও, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসকল ক্ষমা করবেন, বস্তুতঃ আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা আলু ইমরান : ৩১)

পাঠকবৃন্দ! মাযহাবের কোন সিদ্ধান্ত সহীহ্ হাদীস বা সহীহ দলীল বিরোধী কিংবা দলীলহীন হওয়া সত্ত্বেও তার অনুসরণ করলে আল্লাহ্ ভালো বাসবেন এরূপ দলীল কারো নিকট আছে কি? নিশ্চয় নেই, তাহলে কাকে খুশি করার জন্য আর কার ভালোবাসা লাভের জন্য এরূপ অন্ধভক্তি!? অথচ এরূপ অন্ধভক্তির কারণেই যুগে যুগে সমাজে শির্ক চালু হয়েছে এবং বর্তমানেও চলছে।

আবার সমাজের মধ্যে এক শ্রেণীর লোককে বলতে শোনা যায় এবং কিছু কিছু কিতাবের মধ্যে লেখা হয়: মযহাব মানা হচ্ছে ফরয। কিন্তু তারা চিন্তা করলেন না যে, রসূল (স) এর মৃত্যুর বহু পরে ইমামগণ জন্ম গ্রহণ করলেন যেমন ইমাম আবূ হানীফা ৮০ হিজরীতে আর অন্যরা আরো পরে আর মাযহাব চালু হলো তাদেরও মৃত্যুর কয়েকশ বছর পরে। অতএব আল্লাহ্ তা’য়ালা কার মাধ্যেমে মাযহাবকে ফরয করলেন?

যে সব আমল আর কর্মের স্বপক্ষে কোন সহীহ দলীল নেই সেগুলোকে চালু রাখার জন্য এরূপ আরো কত বাহানা আর অযুহাত দাঁড় করানো হয়ে থাকে। আল্লাহ্ সবাইকে সকল প্রকার গোড়ামী হতে হেফাযাত করুন।

আমি বলছি না যে, আলেম ওলামা ও ইমামদের অনুসরণ করা যাবে না। অবশ্যই তাদের অনুসরণ করতে হবে তবে তাদের সে কথাগুলোরই অনুসরণ করতে হবে যেগুলো সহীহ্ হাদীসের সাথে মিলবে। আর তাদের সে কথাগুলো ত্যাগ করতে হবে যেগুলো সহীহ হাদীসের সাথে মিলবে না। মাযহাবের সে কথাই গ্রহণ করতে হবে যে কথা সহীহ দলীলের সাথে মিলবে আর যে কথা সহীহ দলীলের সাথে মিলবে না সে কথা ত্যাগ করে সহীহ্ হাদীসের এবং সহীহ দলীলের অনুসরণ করতে হবে। এরূপ করা হলেই ইমাম ও মাযহাবকে সত্যিকারে সম্মান করা হবে। অন্যথায় অতিভক্তির ফলে অজান্তে শির্কে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা খুবই বেশী। আর তা আল্লাহর বিধান এবং তাঁর নির্দেশকে শর্তহীনভাবে মেনে নিতে না পারার কারণেই।

মুসলিম ভাই ও বোন! উপরে উল্লেখিত বিভিন্ন শ্রেণীর লোকের বচনগুলো ভিন্ন ভিন্ন হলেও এগুলোর ভাবার্থ এবং উদ্দেশ্য এক। কারণ ঈমানের দাবী অনুযায়ী এদের কোন দলই নিঃশর্তভাবে নাবী (স)-এর নির্ভেজাল সমাধানকে বা সুন্নাতকে মেনে নিতে সক্ষম হয়নি। যার নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা সূরা নিসার ৬৫ নং আয়াতে দিয়েছেন।

فلا وربك لا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا

في أَنْفُسِهِمْ حَرَجاً مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيما

উপরোক্ত উক্তিগুলোর কিছু দিক নিয়ে আমি “নাবী মুহাম্মাদ (স)-এর সুন্নাতের অনুসরণের গুরুত্ব” এবং “মৃত্যু রোগ থেকে শুরু করে মৃত ব্যক্তি কেন্দ্রিক যাবতীয় করণীয় এবং বর্জনীয় বিষয়সমূহ” গ্রন্থদ্বয়ে আলোচনা করেছি। তার পরেও এখানে কিছু কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।

পাঠকবৃন্দ! বাস্তবতা এই যে, মুসলিম সমাজ আজ দলে দলে বিভক্ত আর মনে হয় সব দলই নিজেদেরকে সঠিকের উপরে রয়েছে বলে দাবী করে যাকে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বিভক্ত মুসলিম মিল্লাতের সব দলগুলোই কি বাস্তবে সঠিক পথের উপরে রয়েছে? আমরা সলাতের প্রত্যেক রাক’আতে সূরা ফাতিহার মধ্যে সিরাতুল মুসতাকীম (সোজা সরল পথ) চেয়ে থাকি। কিন্তু সব দলই কি সিরাতুল মুসতাকীমের উপরে প্রতিষ্ঠিত? না, এরূপ হওয়ার কথা নয়। কারণ, সিরাতুল মুস্তাকিমের ব্যাখ্যায় হাদীসের ভাষায় তা জানুন:

قَالَ عَبْدُ اللَّهِ ابْنُ مَسْعُودٍ رَضِيَ الله عنه : « خط لَنَا رَسُولُ الله صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَطا ، وَقَالَ : ” هَذَا سَبِيل الله ” ، ثم خط خطوطًا عَنْ يَمِينِهِ وَعَنْ يَسَارِه ، وَقَالَ : ” هَذِهِ سُبُلَ ، عَلَى كُلِّ سَبِيلٍ شَيْطَان يَدْعُو إِلَيْهِ ” ، ثُمَّ قَرَأَ : ﴿ وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السَّبُلَ فَتَفَرقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ

আব্দুল্লাহ্ ইবনু মাসউদ হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন: রসূল (স) একটি (দীর্ঘ) দাগ কেটে বললেন : এটি হচ্ছে আল্লাহর পথ। অতঃপর তিনি তার ডানে এবং বামে অনেকগুলো দাগ কেটে বললেন : এগুলো বহুপথ এগুলোর প্রতিটিতে শয়তান (রয়েছে) সে সেদিকে আহবান করছে। অতঃপর পাঠ করলেন :

অর্থাৎ : কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা মু’মিন হবে না, যে পর্যন্ত তারা তাদের বিবাদ-বিসম্বাদের মীমাংসার ভার তোমার উপর ন্যস্ত না করে, অতঃপর তোমার ফয়সালার ব্যাপারে তাদের মনে কিছু মাত্র কুণ্ঠাবোধ না থাকে, আর তারা তার সামনে নিজেদেরকে পূর্ণরূপে সমর্পণ করে। (সূরা নিসা : ৬৫)

এ কারণে এগুলোর উত্তর মিলে যাবে যদি একটু বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়া যায় তাহলেই। কারণ সব মানুষের বিবেক-বুদ্ধি বা বুঝশক্তি এক নয় ।

وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ

عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ)

অর্থাৎ, “আর এটাই আমার সঠিক সরল পথ, কাজেই তোমরা তার অনুসরণ কর, আর নানান পথের অনুসরণ করো না, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। এভাবে তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা তাঁকে ভয় করে যাবতীয় পাপ থেকে বেঁচে চলতে পার।” (সূরা আন’আম : ১৫৩ )

অন্যভাবে আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখব, একই বিষয়ের ক্ষেত্রে একজন বলছেন হালাল আবার অন্যজন বলছেন হারাম, একজন বলছেন গুনাহের কাজ অন্যজন বলছেন নেকির কাজ। ইসলামী শারীয়াতের মধ্যে এত বৈপরীত্য থাকতে পারে না। অতএব দু’টি সিদ্ধান্তের যে কোন একটি ভূল হিসেবে গণ্য হবেই।

আর যদি সব দলগুলোই সঠিক পথের উপর থাকত তাহলে রসূল (স) হাদীসের মধ্যে বলতেন না যে, আর আমার উম্মাত তেহাত্তর দলে বিভক্ত হবে। যাদের একটি মাত্র দল বাদে বাকী সব দলগুলোই জাহান্নামে যাবে।” [“সহীহ্ তিরমিযী (২৬৪১)]। অন্য এক হাদীসে বাহাত্তর দলের কথা বলা হয়েছে যেগুলোর একটি বাদে বাকী সবগুলোই জাহান্নামে যাবে। (দেখুন “সহীহ্ ইবনু মাজাহ” (৩৯৯৩)।

আবার তিনি বলতেন না যে, কিয়ামাত দিবস পর্যন্ত একটি মাত্র দল হজ্বের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।

عَنْ تَوْبَانَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّمَا أَخَافُ عَلَى أُمَّنِي الأَئِمَّةُ الْمُصَلِّينَ قَالَ وَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ لَا بصرهم من يخذلهم .

সাওবান হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন : রসূল (স) বলেছেন: আমার উম্মাতের জন্য আমি পথভ্রষ্ট ইমামদেরকে (আলেমদেরকে) ভয় করছি। রসূল (স) আরো বলেন : আমার উম্মাতের একটি দল হজ্বের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। কোন ব্যক্তি কর্তৃক তাদেরকে অপমানিত করার প্রচেষ্টা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না …। [দেখুন “মুসলিম ( ) ও “সহীহ্ তিরমিযী” (২২২৯)। ইমাম তিরমিযী উল্লেখ করেছেন যে, আলী ইবনুল মাদীনী বলেন সে দলটি হচ্ছে হাদীসের অনুসরণকারীগণ। এরূপ হাদীস আবু দাউদ ও বর্ণনা করেছেন, দেখুন “সহীহ্ আবী দাউদ (৪২৫২)]। অতএব রসূল (স) এর বাণী থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় সহীহ্ সুন্নাহ্ থেকে বিমুখ করার ক্ষেত্রে এক শ্রেণীর ইমামরা (আলেমরাও) স্বচেষ্ট থাকবে এবং তারা সচেষ্ট আছেও বটে। এখানে ইমাম মালেক হতে বর্ণিত একটি উক্তি উল্লেখ না করলেই তিনি বলেন : নাবী (স)-এর পরে এমন একজন ব্যক্তিও নেই যার কথা গ্রহণীয় আবার বর্জনীয় নয়। একমাত্র নাবী (স)-এর কোন কথা (সুন্নাত) বর্জনীয় নয়। অর্থাৎ নাবী (স)-এর সুন্নাত ব্যতীত অন্য যে কোন ব্যক্তির কথা বা মত গ্রহণ করার পরেও বর্জনীয় যদি তা সহীহ্ সুন্নাতের সাথে না মিলে। (ইবনু আব্দিল বার তার “আল-জামি” গ্রন্থে (২/৯১) উল্লেখ করেছেন)। তিনি আরো বলেন: সুন্নাত হচ্ছে নূহ (আঃ)’র কিস্তি যে ব্যক্তি তাতে আরোহণ করবে সে রেহাই পাবে, আর যে তার থেকে পশ্চাতে থাকবে (পিছপা হবে) সে ডুবে যাবে। (এটিকে খাতীব বাগদাদী “তারীখু বাগদাদ” গ্রন্থে (৭/৩৩৬) ও আবুল ফাল মুকরী “আহাদীসু যাম্মিল কালাম অ- আলিহি” গ্রন্থে (৫/৮১) উল্লেখ করেছেন)।

অতএব যে কেউ কোন মত প্রকাশ করুন না কেন এবং তার এ মতের অনুসারীর সংখ্যা যত বেশীই হোক না কেন এবং যে কোন স্থানেই এ মতের উপর আমল করা হোক না কেন তা বিবেচ্য হতে পারে না। বরং বিবেচ্য বিষয় হতে হবে কার পক্ষে সহীহ্ এবং সঠিক দলীল-প্রমাণ রয়েছে তা অনুসন্ধান করা। মুসলিম সমাজ দলীল প্রমাণ অনুসন্ধান করা থেকে দূরে সরে গিয়ে অনেকের অন্ধ অনুসরণের কারণেই আজ শত দলে বিভক্ত। আর এ বিভক্তি থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে অন্ধ অনুসরণকে ত্যাগ করে দলীলের অনুসরণ করা। অতএব আমাদেরকে খুঁজতে হবে সহীহ দলীল, চাইতে হবে সহীহ্ দলীল, আর ধাবিত হতে হবে সহীহ্ দলীল ভিত্তিক আমলের দিকে। তাহলেই আমরা নাবী (স) এর সহীহ্ তরীকাহ্ এবং তাঁর সহাবীগণের পথের উপর নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব এবং সরাসরি যে দল জান্নাতে যাবে সে দলের অন্তর্ভুক্ত হতে পারব এবং মুসলিম সমাজে পরস্পরের মাঝের দূরত্বও কমে আসবে ইন শা আল্লাহ্ ।

সবার বুঝা উচিত ছিল যে, শুধু ভালোই নয় বরং বাহ্যিকআবে উত্তম নিয়্যাতে সর্বোত্তম কর্ম করা হলেও তা করে নাবী (স)-এর তরীকা থেকে বের হয়ে যেতে হবে যদি চমৎকার নিয়্যাতে করা সর্বোত্তম আমলের সমর্থনে কুরআন এবং সহীহ্ হাদীস থেকে দলীল না মিলে।

কারণ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসের মধ্যে সেই তিন ব্যক্তির। (যারা ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিমগণের অন্তর্ভুক্ত এবং যাদের প্রতি আল্লাহ্ রব্বুল আলামীনও সন্তুষ্ট ছিলেন। তারা হচ্ছেন নাবী -এর সাথী (সহাবী)। ঘটনা যাদের একজন সারা রাত না ঘুমিয়ে বাকী জীবন শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদাতে সলাত আদায় করে কাটিয়ে দেয়ার সংকল্প করেছিলেন, আরেকজন বাকী জীবনের প্রতিদিনই সপ্তম পালন করবেন মর্মে সংকল্প করেছিলেন আর তৃতীয়জন শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করার লক্ষ্যে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এতো চমৎকার নিয়্যাত এবং ভালো ভালো আমল করার দৃঢ় সংকল্পগুলো রসূল (স) শুনার পর কি বলেছিলেন মর্মে বর্ণিত হাদীসটি সম্পূর্ণ উল্লেখ করা হলো :

আনাস ইবনু মালেক (র) হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন: কতিপয় ব্যক্তি নাবী (স)-এর স্ত্রীগণের গৃহের নিকট এসে নাবী (স)-এর ইবাদাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। তাদেরকে যখন তাঁর ইবাদাত সম্পর্কে সংবাদ দেয়া হলো তখন তারা যেন নাবী (স)-এর ইবাদাতকে সামান্য মনে করল। তারা বললঃ নাবী (স)-এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যাবতীয় গুনাহ্ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে তার পরেও যখন তিনি এতো বেশী ইবাদাত করতেন] তখন তাঁর তুলনায় আমরা কোথায়? তাই তাদের একজন বলল : আমি এখন থেকে সর্বদাই সারা রাত ধরে সলাত আদায় করব। আরেকজন বলল : আমি সারা বছরব্যাপী সওম পালন করব কক্ষণও সওম ভঙ্গ করব না। আরেকজন বলল : আমি স্ত্রীদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকব কক্ষণও বিয়ে করব না। অতঃপর রসুল (স) তাদের নিকটে এসে বললেনঃ তোমরাই কি এরূপ এরূপ কথা বলছিলে? আর আমি! আল্লাহর কসম অবশ্যই তোমাদের চেয়ে আল্লাহকে বেশী ভয় করি এবং তোমাদের চেয়ে আমি বেশী পরহেযগার। তা সত্ত্বেও আমি সওম রাখি, ভঙ্গ করি, [রাতে) সলাত আদায় করি, আবার নিদ্রাও যাই এবং আমি মহিলাদেরকে বিয়েও করেছি। । এটিই হচ্ছে আমার তরীকা ] অতএব যে আমার এ সুন্নাত থেকে বিমুখ হবে সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়।

অতএব আমল বাহ্যিকভাবে ভালো হলেই চলবে না। বরং আপনার দৃষ্টিতে এ ভালো আমলটিকে রসূল ( ভালো হিসেবে জানতেন কি জানতেন না। এ তথ্যটিও জানতে হবে। আপনি যদি বলেন যে এটি ভালো* (হাদীসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন)।

তাহলে আপনার প্রতি প্রশ্ন আসবে আপনার এ ভালো কর্মটি রসূল (স) কি জানতেন? যদি বলেন, জানতেন। তাহলে আপনাকে তিনি যে জানতেন তার প্রমাণ দিতে হবে? ঐ প্রমাণটি সঠিক হলে সেটিই তো দলীল। আর যদি বলেন : তিনি জানতেন না (জানবেন কিভাবে তাঁর যুগেতো ছিলই না)- তাহলে বলতে হবে যে, ভালো কর্ম নির্ধারণে আপনি রসূল (স)-এর চেয়েও বেশী জ্ঞানী (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক)। কারণ তিনি আল্লাহর নাবী ও রসুল হয়েও তা ভালো মনে করে বলে গেলেন না অথচ আপনি কর্মটিকে ভালো বিদ’আত বলে দিব্বি করে এবং বলে যাচ্ছেন অথবা চালু আছে আর আপনি তার অনুসরণ করছেন।

এ শেষোক্ত হাদীসটি প্রমাণ করছে যে, ভাল মনে করে কোন ইবাদাত করলেও সে ইবাদাত গ্রহণযোগ্য হবে না যে পর্যন্ত সে ইবাদাতের সমর্থনে সহীহ্ হাদীস দ্বারা দলীল বা প্রমাণ না মিলবে। কারণ সপ্তম ও সলাত শুধু ভাল ইবাদাতই নয় বরং সর্বোত্তম ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত, আর যে ব্যক্তি বিয়েকে ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন তিনিও আল্লাহর ইবাদাত করার উদ্দেশ্যেই বিয়েকে ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। অতএব নিয়্যাত ভালই ছিল। এতো চমৎকার নিয়্যাত থাকা সত্ত্বেও রসূল (স) তাদের এ মহৎ উদ্দেশ্যগুলোকে প্রত্যাখ্যান করলেন। কারণ, তারা রসূল (স)-এর সুন্নাত (তরীকা) বিরোধী (সুন্নাতে নেই এরূপ) সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন।

এ হাদীস থেকে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে যে, ভাল কর্ম হলেও তার সমর্থনে শার’ঈ দলীল না মিললে তা ভাল নয় বরং তা মন্দ কর্ম হিসেবেই গণ্য হবে। যাকে ইসলামী শারীয়াতের ভাষায় বিদ’আত বলা হয়, যে বিদ’আতের সাথে জড়িত হলে পরিণতিটা অত্যন্ত ভয়াবহ। বিদ’আতের পরিণতিগুলো সম্পর্কে আমি যঈফারই ২য় খণ্ডের ভূমিকাতে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সেখানে বিদ’আতের ১৭টি ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে দলীল ভিত্তিক আলোচনা করেছি। যার মধ্যে রয়েছে: বিদ’আতী কিয়ামাতের দিন হাওযে কাউসারের পানি পান করতে সক্ষম হবে না, বিদ’আতী অভিশপ্ত, তার আমল গ্রহণযোগ্য হবে না, বিদ’আতের সাথে জড়িত থাকা পর্যন্ত অন্য কোন গুনাহ্ থেকে তাওবা করতে চাইলেও বিদ’আত ত্যাগ না করা পর্যন্ত বিদ’আতীর তাওবা কবূল হবে না এবং বিদ’আত কিয়ামাতের দিন নাবী (স)-এর শাফা’আত লাভকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে বাধা প্রদান করবে ইত্যাদি। আর এসব ভয়াবহ কুপরিণতি থেকে রক্ষার লক্ষ্যেই মুসলিম সমাজকে বিদ’আতের ব্যাপারে সতর্ক করার চেষ্টা করছি।

যারা ভালো মনে করে কুরআন এবং সহীহ্ হাদীসে নেই তা সত্ত্বেও কিছু আমল করে থাকেন। তারা এ আমল কেন করে থাকেন? অবশ্যই এরূপ আমল করার উদ্দেশ্য হচ্ছে কিছু সাওয়াব অর্জন করা যার মাধ্যমে জান্নাত লাভ করা সম্ভব হবে। কারণ এ উদ্দেশ্য না থাকলে সে কর্ম করাটাতো বেকার হয়ে যায়। আর বেকার ও অনর্থক কাজ তো কারো করার কথা নয়।

কিন্তু এমন কোন কর্ম বা আমল আছে কি যে কর্মটি করলে জান্নাত লাভ করা যাবে অথবা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যাবে অথচ রসূল (স) সে কর্ম সম্পর্কে কিছু বলে জাননি অথবা তাঁর সহাবীগণকে অবহিত করেননি? রসূল (স) নিজেই এর উত্তর দিয়ে গেছেন:

وَمَا تَرَكْتُ شَيْئًا يُبْعِدُكُمْ عَنِ اللَّهِ ما تركت شيئًا يُقَرِّبُكُم إلى الله إلا وقد أمرئكُم به

ويُقربُكُمْ إِلَى النَّارِ إِلَّا وَقَدْ لهبْتُكُمْ عَنْهُ.

তিনি বলেনঃ “আমি তোমাদেরকে এমন কোন কিছুর নির্দেশ দিতে ছাড়িনি যা তোমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করবে। আর আমি তোমাদেরকে এমন কোন কিছু থেকে নিষেধ করতেও ছাড়িনি যা তোমাদেরকে আল্লাহ্ থেকে দূরে সরিয়ে দিবে এবং জাহান্নামের নিকটবর্তী করবে।ভাবার্থ এক হলেও উক্ত হাদীসটি বিভিন্ন ভাষায় বর্ণিত হয়েছে, বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় সব ভাষাগুলোই এখানে উল্লেখ করা হলো : তিনি আরো বলেন ঃ

وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ مَا تَرَكْتُ شَيْئًا يُقَرِّبُكُمْ مِنَ الْجِنَّةِ وَيُبَاعِدُكُمْ عَنِ النَّارِ إِلَّا أَمَرْتُكُمْ

بِهِ وَمَا تَرَكْتُ شَيْئًا يُقَرِّبِّكُمْ مِنَ النَّارِ وَتَبَاعِدُكُمْ عَنِ الْحَلةَ إِلَّا لَهَيْنَكُمْ عَنْهُ.

“সেই সত্ত্বার কসম যাঁর হাতে আমার আত্মা! আমি তোমাদেরকে এমন কোন কিছুর নির্দেশ দিতে ছাড়িনি যা তোমাদেরকে জান্নাতের নিকটবর্তী করবে আর জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। আবার আমি তোমাদেরকে এমন কোন কিছু থেকে নিষেধ করতেও ছাড়িনি যা তোমাদেরকে জাহান্নামের নিকটবর্তী করবে আর জান্নাত থেকে দূরে সরিয়ে দিবে””

* (হাদীসটি সহীহ্ দেখুন শাইখ আলবানী কর্তৃক রচিত গ্রন্থ “হাজ্জাতুন নাবী ” (পৃ: ১০৩) ৩ “মানাসিকুল হাজ্জ অল-উমরাহ্ ফিল কিভাবে অস-সুন্নাহ্… ” (পৃঃ ৪৭) )। (এ হাদীসটি সহীহ, দেখুন শাইখ আলবানী রচিত গ্রন্থ “তাহরী আলাভিত জ্বরবে” (১৭৬), এ

আবূ যার গেফারী বলেন : জান্নাতের নিকটবর্তী করবে আর জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে তোমাদের জন্য এমন কোন কিছুর বর্ণনা দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি কিছুই অবশিষ্ট রেখে যাননি। তার থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন : রসূল (স) আমাদেরকে এমতাবস্থায় ছেড়ে গেছেন যে, বাতাসে কোন পাখি তার ডানায় নাড়ালে তার সম্পর্কেও তিনি আমাদেরকে জ্ঞান দিয়ে গেছেন। এ হাদীসের নিম্নের বাক্যে একটি শাহেদ (সাক্ষীমূলক হাদীস বর্ণিত হয়েছে: রসূল (স) বলেছেন: “তোমাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলা যা কিছু করার নির্দেশ দিয়েছেন তার কোন কিছুই আমি তোমাদেরকে নির্দেশ দিতে ছাড়িনি। আর তিনি তোমাদেরকে যা কিছু করা থেকে নিষেধ করেছেন তার কোন কিছু থেকেই তোমাদেরকে আমি নিষেধ করতে ছাড়িনি।

অতএব কেউ যদি বলেন যে, কিছু ভাল কর্ম ছুটে গেছে যেগুলোকে ভাল কর্ম হিসেবে করতে পারব, তাহলে মনে করতে হবে যে, রসূল (স)-এর প্রতি তার ঈমান আনার ক্ষেত্রে এখনও ঘাটতি রয়ে গেছে আর না হয় সে ঈমানদারই হতে পরেনি।

অন্য এক হাদীসের মধ্যে একটু ভিন্ন ভাষায় এসেছে:

عَنِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنْ رَسُولَ اللَّهِ قَالَ: لَيْسَ مِنْ عَمَلٍ يُقَرِّبُ مِنَ الْجِنَّةِ إِلا قَدْ أَمَرَ لَكُمْ بِهِ وَلاَ عَمَلٍ يُقَرِّبُ مِنَ النَّارِ إلا وقد نهيتكم عن

আব্দুল্লাহ্ ইবনু মাস’উদ হতে বর্ণিত হয়েছে, রসূল (স) বলেন :আমি তোমাদেরকে জান্নাতের নিকটবর্তী করবে এমন কোন আমলের নির্দেশ দিতে ছাড়িনি আর আমি তোমাদেরকে জাহান্নামের নিকটবর্তী করবে এরূপ কোন আমল থেকে নিষেধ করতেও ছাড়িনি……..মুসলিম ভাই ও বোন! যারা বিদ’আতে হাসানার কথা বলে থাকেন তাদের প্রধান দলীল হচ্ছে উমার-এর একটি উক্তি। হাদীসটি আল্লামাহ্ আলূসী স্বীয় গ্রন্থ “তাফসীর বহুল মা’আনী” এর মধ্যেও (২১/৭৯) উল্লেখ করেছেন)।

‘(শাইখ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ্ আখ্যা দিয়েছেন, দেখুন “সিলসিলা সহীহাহ্” (১৮০৩)। (হাদীসটি ইমাম হাকিম (৩/৫-২১২৬), আৰু বা আদুল্লাহ্ ইবনু আবী শাইবাহ্ আল- মুসান্নাফ” গ্রন্থে (৭/৭৯, ৩৪৩৩২) ও বাইহাকী “শুআবুল ঈমান” গ্রন্থে (৭/২৯৯, ১০৩৭৬) বর্ণনা করেছেন। হাদীসটিকে শাইখ আলবানী সহীহ্ আখ্যা দিয়েছেন, দেখুন “সিলসিলা সহীহ্” (২৮৬৬) ও “সহীহ তারগীব অন্ত-তারহীব” (1900) 

উমার (র) রমাযানের কিয়ামুল লাইল সম্পর্কে বলেনঃ

“এটি কতই না সুন্দর বিদ’আত।” [বুখারী (২০১০)।। উমার-এর এ বাণীর ব্যাখ্যা সম্পর্কে য’ঈফারই দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকায় আলোচনা করেছি। কারণ ভালকাজ বলে শারী’য়াতের মধ্যে সাওয়াবের প্রত্যাশায় কিছু নতুনভাবে চালু করা নিন্দনীয়। যদিও সেটিকে সকলে মিলে ভালকাজ বলেই স্বীকৃতি প্রদান করে। আশা করি পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, যে হাদীসের মধ্যে বলা হয়েছে যে, রসূল (স) জামা’আতের সাথে রমাযানের রাতের সলাত আদায় করা অব্যাহত রাখেননি সে হাদীসেই বলা হয়েছে যে, তিনি ফরয হয়ে যাওয়ার আশংকায় তা করা অব্যাহত রাখেননি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে ফরয হয়ে যাওয়ার কোনই সুযোগ নেই কিংবা ছিল না, সে কারণেই রসুল প্রো-এর সেই জামা’আতবদ্ধভাবে সলাত আদায়কে উমার কতই না ভাল বিদ’আত বলে চালু করেছিলেন মাত্র। অতএব এ জামা’আতবদ্ধতার দৃষ্টান্ত রসূল (স)-এর যুগেই ছিল। আর এ কারণেই উমার (চন্দ্র-এর উক্ত বাণীতে উল্লেখিত বিদা’আত শব্দ দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে তা একান্তই জানা দরকার। বিষয়টি গুরুত্ত্বপূর্ণ বিধায় এখানেও আলোচনা করা হলো :

প্রথমত আমরা তাঁর উক্তিটিকে দু’ভাবে নিতে পারি :

১। যদি ধরে নেই যে, বিদ’আতে হাসানার সমর্থনে তাঁর উক্তিটি একটি অকাট্য দলীল। এ দলীল হতে অন্য দিকে মুখ ফেরানোর কোনই সুযোগ নেই। তাহলে বলবো, রসূল (স) বলেছেন: (শারী’য়াতের মাঝে) প্রত্যেক নবাবিষ্কারই বিদ’আত আর প্রত্যেক বিদ’আত ভ্রষ্টতা। আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণামই জাহান্নাম’। ‘কুল্লু’ শব্দটি ব্যপকতার অর্থ বহন করে। অর্থাৎ শারীয়াতের মধ্যে ইবাদাত হিসাবে যা কিছুই নবাবিষ্কার করা হবে তার সবই বিদ’আত। [এ ব্যাখ্যা দেয়ার কারণ সমাজের মধ্যে এমন আলেমও রয়েছেন, যিনি বলেন তাহলে মাদ্ররাসা প্রতিষ্ঠা করা, বই ছাপানো ইত্যাদিও বিদ’আত। তার উদ্দেশ্যে বলছি, এগুলো বিদ’আত নয় এগুলো হচ্ছে কুরআন ও হাদীস বুঝার মাধ্যম। কিয়ামত দিবস পর্যন্ত এগুলোর উন্নতি সাধন হতেই থাকবে এবং এগুলো সাদাকার হাদীসের অন্তর্ভুক্ত। তবে মাধ্যমগুলোও আবার শারীয়াত সম্মত হতে হবে। শারীয়াত সম্মত নয় এমন মাধ্যমও রয়েছে। যখন আলেম সাহেব বুৎবাহ দিচ্ছেন, তখন সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার আর শিরক-বিদ’আতকে পরিহার করার জন্য সুমধুর কন্ঠে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যখন তাকে বিদ’আতগুলো চিহ্নিত করে দেখানো হচ্ছে, তখন তিনি বিদ’আত কী আর কোনটিইবা বিদ’আত কিংবা বিদ’আতের অর্থইবা কী তিনি সে সবের আর কিছুই জানেন না। ফলে তিনি তখন বনে যাচ্ছেন বিদ’আতের ধারক ও বাহক। আর তার মাঝের বিদ’আতকে চিহ্নিত করার কারণে যিনি সুন্নাতের অনুসারী তিনি হচ্ছেন তার দুশমন ।

রসূল (স) বললেন : ‘প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা’। উমার-এর উক্তি কী রসূল (স)-এর এ কথার সাথে সাংঘর্ষিক না সাংঘর্ষিক নয়? তর্কের খাতিরে যদি বলি অবশ্যই সাংঘর্ষিক। তাহলে বলবো পাঠক ভাই ও বোনেরা! আপনারা রসূল (স)-এর কথা মানবেন, না উমার এর কথা মানবেন? আল্লাহ্ আপনার উপর রসূল (স)-এর অনুসরণ করা ফরয করেছেন না উমার এর কথার অনুসরণ করা ফরয করেছেন? এ সিদ্ধান্ত টি নেয়ার দায়িত্ব আপনাদের উপরেই ছেড়ে দিলাম। যে কোন মুসলিম ব্যক্তি যার মধ্যে সামান্যতম ঈমান আছে তিনিও বলবেন অবশ্যই আমি রসূল (স)-এর অনুসরণ করব।

২। উমার কি রসূল (স)-এর হাদীসটি জানতেন না? কীভাবে তিনি তার উক্ত বাক্যটি বললেন? অবশ্যই এর উত্তরে সকলে একমত হবেন এটি আবার কি করে হয় যে, রসূল (স) খুতবার মধ্যে উক্ত হাদীসটি পাঠ করতেন আর উমার তা জানতেন না বা তিনি তা শুনেননি? এরূপ হতে পারে না। অর্থাৎ তিনি হাদীসটি জানতেন। তাহলে তিনি কী জেনে শুনেই তাঁর বিরোধিতা করলেন নাকি তার উক্তির ভিন্ন অর্থ রয়েছে। সে অর্থকে এড়িয়ে গিয়ে তারা বিদ’আতকে সাব্যস্ত করার জন্য তার উক্তিটিকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করছেন। উমার রসূল (স) -এর কথার বিরোধিতা করবেন এটা অসম্ভব। কারণ তিনি আল্লাহ ও তাঁর নাবীর কথার আনুগত্যের ক্ষেত্রে খুবই কঠোর ছিলেন। যার প্রমাণ মিলে বহু ঘটনা থেকে। অতএব অবশ্যই তিনি তার এ বিদ’আত দ্বারা এমন অর্থ বুঝাতে চাননি যে অর্থ রসূল (স) তাঁর বাণী দ্বারা বুঝিয়েছেন।

পাঠক মণ্ডলী লক্ষ্য করুন! উমার লোকদেরকে এক ইমামের অধীনে তারাবীর সলাত আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। রসূল (স)-এর যুগেও কিন্তু এ সলাত আদায় করা হয়েছে। শুধু তাই নয় তিনি তিনরাত জামা’আতের সাথেও রমাযান মাসে কিয়ামুল লাইলের সলাত আদায় করেছেন, চতুর্থ রাতে আর বের হননি। রসূল প্রেমে বের না হওয়ার কারণও দর্শিয়েছেন :

ipe 1s mais Sle এর এই “আমি ভয় করছি যে, তা তোমাদের উপর ফরয করে দেয়া হবে, অতঃপর তোমরা তা আদায় করতে অপারগ হয়ে যাবে।” তিনি সহাবাদেরকে নিয়ে জামা’আতের সাথে সলাত আদায় করা অব্যহত না রাখার কারণ বর্ণনা করেছেন, যাতে তোমাদের উপর ফরয করে দেয়া না হয় এ ভয়ে। অতএব যেহেতু উমার (র) দেখলেন এখন আর ফরয হওয়ার কোন সুযোগ নেই। কারণ যার মাধ্যমে ফরয হবে তিনি তো আর আমাদের মাঝে নেই। ফলে তিনি লোকদেরকে যখন দেখলেন যে, কেউ একাকি, কেউ আরেকজনকে সাথে নিয়ে, কেউ দু’জনকে সাথে নিয়ে কিংবা কেউ কয়েকজনকে সাথে নিয়ে সলাত আদায় করছে। তখন তিনি এ বিশৃঙ্খল অবস্থার অবসানকল্পে এক ইমামের পিছনে সলাত আদায় করার নির্দেশ দিলেন। তিনি রসূল (স)-এর সেই জামা’আতবদ্ধভাবে রমাযানের রাতের সলাত আদায় করাকে পুনরায় চালু করলেন। তিনি নতুন করে কোন ভিত্তিহীন ইবাদাত চালু করেননি। বরং তিনি প্রতিষ্ঠিত ইবাদাতকে সুশৃঙ্খলভাবে আদায় করার জন্য পুনরায় চালু করেন। অতএব তাঁর উক্তি দ্বারা ভাল বিদ’আত বলে শারীয়াতের মধ্যে কোন নতুন ইবাদাত চালু করার কোনই সুযোগ নেই।

রমাযান মাসের রাতের সলাত জামা’আতের সাথে আদায় করাকে রসূল (স) সঙ্গত কারণে ছেড়ে দিয়েছিলেন। সে কারণ অবশিষ্ট না থাকা সত্ত্বেও আবু বাক্ পুনরায় চালু করেননি। কিন্তু উমার জামা’আতের সাথে তা আদায় করার নির্দেশ দিয়ে বাহ্যিক অবস্থার দিকে লক্ষ্য করে এটিকে ভাল বিদ’আত বলে সম্বোধন করেন। দীর্ঘ দিন সম্মিলিত জামা’আতের সাথে চালু না থাকাই যেন বাহ্যিকভাবে নযীরহীন কিছু চালু করা হয়েছে। সেই হেতু তিনি বিদ’আত বলে সম্বোধন করেন। পারিভাষিক অর্থের সাথে এর কোন সামঞ্জস্য নেই। এরূপ ব্যাখ্যা করা ছাড়া কোন অবস্থাতেই বিদ’আত শব্দের মূল আভিধানিক এবং পারিভাষিক অর্থের সাথে তাঁর থেকে উচ্চারণকৃত বিদ’আত শব্দের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ এ সলাত নযীরহীন নয়, অথচ নতুনভাবে আবিষ্কৃত নযীরহীন কিছুকেই আভিধানিক অর্থে বিদ’আত বলা হয়। আবার কোন কোন ব্যক্তি বিদ’আতে হাসানাহ (ভাল বিদ’আত) সাব্যস্ত করার জন্য রসূল (স)-এর নিম্নোক্ত হাদীস পেশ করে থাকেন। যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে ভাল সুন্নাত চালু করবে, সে তার ও তার উপর যে ব্যক্তি আমল করবে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত তার সাওয়াব পাবে’। চিন্তা করা প্রয়োজন ছিল রসূল (স) কিন্তু বলেননি, যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে ভাল বিদ’আত চালু করবে…। বলেছেন ভাল সুন্নাত চালু করবে। কারণ বিদ’আত কখনও ভাল হতে পারে না। আর সুন্নাত সর্বদাই ভাল।

এছাড়াও এ হাদীসটি যিনি বলেছেন, তিনিই কিন্তু সে হাদীসটিও বলেছেন। যাতে বলা হয়েছে যে, ‘প্রত্যেক বিদ’আতই ভ্রষ্টতা’। একই ব্যক্তি আবার আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নাবী ও রসূল )। তিনি কী এমন কথা বলতে পারেন, যা তাঁরই অন্য কথাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে? অবশ্যই না। আর রসূল (স)-এর কথায় দ্বন্দ্বও সৃষ্টি হতে পারে না। আবার এ হাদীসের ব্যাখ্যা এরূপও হতে পারেঃ সুন্নাত চালু করার অর্থ হচ্ছে, সেই সুন্নাতকে জীবিত করা, যেটি এক সময় সমাজে চালু ছিল কিন্তু বর্তমানে সেটির উপর আমল হচ্ছে না।

এছাড়া আরেকটি উত্তর এই যে, হাদীসটি রসূল (স) কেন বলেছিলেন সে দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। তাতেই স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, বিদ’আতে হাসানাহ সাব্যস্ত করার জন্য কোন দিনই হাদীসটি দলীল হতে পারে না। রসূল (স) এর নিকট মুযার গোত্রের কতিপয় লোক অত্যন্ত ক্ষুধার্থ ও বেহাল অবস্থায় আসলে তিনি সলাত আদায়ের পর খুৎবাহ দিয়ে সাদাকাহ করার দিকে ইঙ্গিত করলে, সাহাবাহগণ যে যা পারলেন সামর্থানুযায়ী দিলেন। ইতিমধ্যে এক আনসারী ব্যক্তি তার হাতে রৌপ্যের একটি ভারী পোটলা নিয়ে রসূল (স) এর সামনে রেখে দিলেন। তাতে রসূল (স) আনন্দিত হয়ে বললেন: – ‘যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে ভাল সুন্নাত চালু করবে…’।

আর সবার জানা বিষয় যে, সাদাকা করতে উৎসাহিত করে এবং সাদাকা করার ফাযীলাত বর্ণনা করে বহু সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ফলে রসূল (স) সে ব্যক্তির নতুন কিছু করাকে ভালো সুন্নাত আখ্যা দেননি। এমন কিছুকে ভালো সুন্নাত আখ্যা দিয়েছেন যার ভিত্তি (দলীল) রয়েছে। অতএব এ হাদীস দ্বারা শারী’রাতের মধ্যে নতুন কোন ইবাদাত চালু করার কথা বুঝানো হয়নি। কারণ শারীয়াতের মধ্যে প্রত্যেক বিদ’আতই ভ্রষ্টতা।

আল্লাহ্ আমাদের সকলকে সঠিকভাবে কুরআন বুঝার তাওফীক এবং সহীহ্ হাদীসের জ্ঞান দান করুন এবং সহীহ্ হাদীসের আলোকে জীবন গড়ার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ককে সুদৃঢ় করুন। যে সহীহ্ হাদীস ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে দলে দলে বিভক্ত মুসলিম উম্মাহ্ কখনও ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না।

অনুবাদের মধ্যে বর্ণিত বিভিন্ন ভাষ্য ও উক্তি বুঝার জন্য পাঠকবৃন্দের যা জানা একান্ত অপরিহার্য হাদীস শাস্ত্রের বিধান সম্পর্কীয় যে সব বাক্যের সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা জানা যরূরী, সেগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে প্রদান করা হল:

১। মুতাওয়াতিরঃ সেই হাদীসকে মুতাওয়াতির বলা হয় যেটিকে সংখ্যায় এ পরিমাণ বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন যে, তাদের পক্ষে সাধারণত মিথ্যার উপর একত্রিত হওয়া সম্ভব নয়। এরূপ; বাক্য ও অর্থ উভয় দিক দিয়েই হতে পারে যাকে বলা হয় ‘মুতাওয়াতিরু লাফী’। যেমন: এটিকে সত্তরের অধিক সহাবী বর্ণনা করেছেন। আবার শুধুমাত্র অর্থের দিক দিয়েও হতে পারে। যেমন মুযার উপর মাসাহ করা এবং কবরের আযাব সংক্রান্ত হাদীস। এটিকে বলা হয় মুতাওয়াতিরু মা’নাবী।

২। খবু ওয়াহিদঃ আভিধানিক অর্থে সেই হাদীসকে বলা হয় যেটিকে একজন ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন। আর পারিভাষিক অর্থে সেই হাদীসকে খববু ওয়াহিদ বলা হয়। যার মধ্যে মুতাওয়াতির হাদীসের শর্তাবলী একত্রিত হয়নি।

এই খবর ওয়াহিদ তিন প্রকার :

(ক) মাশহুর ও আভিধানিক অর্থে যে হাদীস মানুষের মুখে মুখে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যদিও সেটি মিথ্যা হয় সেটিকেই মাশহর বলা হয়। আর পারিভাষিক অর্থে সেই হাদীসটিকে মাশহুর বলা হয় যেটি তিন বা ততোধিক বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন। তবে তার (মাশহর) স্তরটি মুতাওয়াভিরের স্তর পর্যন্ত পৌঁছেনি।

(খ) আযীয: সেই হাদীসকেই বলা হয় যার সনদের প্রতিটি স্তরে দুইজন করে বর্ণনাকারী রয়েছে।

(গ) গারীব : যে হাদীসের সনদের কোন এক স্তরে মাত্র একজনে বর্ণনা করেছেন সে হাদীসটিকেই বলা হয় গারীব হাদীস। যেমন বুখারী প্রমুখ গ্রন্থে বর্ণিত নিয়ত সংক্রান্ত এ হাদীসটি।

৩। মারফু: নাবী (ই)-এর কথা, বা কাজ, বা সমর্থনকে বলা হয় ‘মারফূ’ ৪। মওকৃষ্ণ সহাবীর কথা, বা কর্ম, বা সমর্থনকে বলা হয় ‘মওকৃষ্ণ’।

৫। মাকতূ’: তাবে’ঈ বা তার পরের কোন ব্যক্তির কথা বা কাজকে বলা হয় ‘মাক’।

৬। মুসনাদ: যে হাদীসের সনদ (কোন প্রকার বিচ্ছিন্নতা ছাড়াই) নাবী (স) পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে বলা হয় ‘মুসনাদ’।

৭। মুত্তাসিল : যে মারফূ’ বা মওকুফ-এর সনদটিতে কোন প্রকার বিচ্ছিন্নতা নেই তাকেই বলা হয় ‘মুত্তাসিল’।

৭। সহীহ : যে হাদীস সনদের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে ন্যায়পরায়ণ (নির্ভরযোগ্য) এবং পূর্ণাঙ্গ আয়ত্ত্বশক্তি ও হেফযের গুণাবলী সম্বলিত বর্ণনাকারীর মাধ্যমে শায এবং ত্রুটিহীনভাবে বর্ণিত হয়েছে তাকেই বলা হয় ‘সহীহ ‘হাদীস’। এটিকে ‘সহীহ লি যাতিহি’ও বলা হয়।

৮। হাসান : যে হাদীস সনদের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে ন্যায়পরায়ণ (নির্ভরযোগ্য) এবং কিছুটা ত্রুটিযুক্ত আয়ত্ত্বশক্তি ও হেফযের গুণাবলী সম্বলিত বর্ণনাকারীর মাধ্যমে শাষ এবং ত্রুটিহীনভাবে বর্ণিত হয়েছে তাকেই বলা হয় ‘হাসান হাদীস’। এটিকে ‘হাসান লি যাতিহি’ও বলা হয়।

৯। সহীহ লি গায়রিহি (অন্যের কারণে সহীহ) ৪ এটি মূলত হাসান লি যাতিহি। কিন্তু হাসানের একাধিক সূত্র পাওয়া গেলে, সে সময় হাসান হতে সহীহার পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়ে যায়। তবে এর স্তরটি ‘সহীহ লি যাতিহি’র চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের।

১০। হাসান লি গায়রিহি (অন্যের কারণে হাসান) : এটি মূলত দুর্বল হাদীস। কিন্তু যখন তা একাধিক সূত্রে বর্ণিত হয় এবং হাদীসটির বর্ণনাকারী ফাসেক বা মিথ্যার দোষে দোষী হওয়ার কারণে দুর্বল না হয়, তখন এটি অন্যান্য সূত্রগুলোর কারণে ‘হাসান’-এর পর্যায়ভুক্ত হয়ে যায়। তবে এর স্তরটি ‘হাসান লি যাতিহি’র চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের।

১১। যঈফ যে সনদে হাসান হাদীসের সনদের গুণাবলী একত্রিত হয়নি, হাসান-এর সনদের শর্তগুলোর যে কোনটি অনুপস্থিত থাকার কারণে, সে সনদের হাদীসটিকে ‘য’ঈফ’ বলা হয়। এই ‘য’ঈফে’র স্তরগুলো বিভিন্ন হতে পারে বর্ণনাকারীর মাঝের দুর্বলতা (ত্রুটি) কম বেশী হওয়ার কারণে। (যেমনভাবে সহীহ হাদীসের স্তরে পার্থক্য রয়েছে বর্ণনাকারী নির্ভরশীল বা বেশী নির্ভরশীল হওয়ার কারণে)। দুর্বলের প্রকার গুলোর মধ্যে রয়েছে; য’ঈফ, য’ঈফ জিদ্দান (নিতান্তই দুর্বল), ওয়াহিন, মুনকার, মুখতারিব, মু’যাল, মুরসাল মু’আল্লাক ইত্যাদি। তবে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট প্রকার হচ্ছে মাওযূ’ (জাল)।

১২। মু’আল্লাক: যে হাদীসের সনদের শুরুতে একজন বা পর্যায়ক্রমে একাধিক বর্ণনাকারী উল্লেখ করা হয়নি সেই হাদীসকে ‘মু’আল্লাক’ বলা হয়। যেমন সনদের সকল বর্ণনাকারীকে উল্লেখ না করে এরূপ বলা যে, রসূল (স) বলেছেন, কিংবা সহাবী বা তাবে’ঈ ছাড়া সনদের সকল বর্ণনাকারীকে উল্লেখ না করা। এ হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।

১৩। মুরসাল: যে সনদের শেষ ভাগে তাবেঈর পরের ব্যক্তি অর্থাৎ সহাবীকে উহ্য রেখে তাবে’ঈ বলবেন : রসুল (স) বলেছেন। এরূপ সনদের হাদীসকে মুরসাল বলা হয়। এরূপ বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়।

১৪। মু’খাল ও যে সনদে দুই বা ততোধিক বর্ণনাকারীকে পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করা হয়নি সেই সনদের হাদীসকে বলা হয় মু’খাল। এরূপ হাদীস দুর্বলের পর্যায়ভুক্ত, গ্রহণযোগ্য নয়।

১৫। মুনকাতি: যে হাদীসের সনদে বিচ্ছিন্নতা ঘটেছে তাকেই বলা হয় ‘মুনকাতি”। এ বিচ্ছিন্নতা যেভাবেই হোক না কেন। মুরসাল, মু’আল্লাক, মুযাল এসব গুলো এরই অন্তর্ভুক্ত। সনদের মধ্যে অজ্ঞতা থাকার কারণে এটি সকল আলেমের ঐকমত্যে দুর্বল হাদীসের অন্তর্গত।

১৬। মাতরূক: সেই হাদীসকে বলা হয় যার সনদে মিথ্যার দোষে দোষী বর্ণনাকারী রয়েছে। এরূপ বর্ণনাকারীর হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।

১৭। মা’রূফ: নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী কর্তৃক দুর্বল বর্ণনাকারীর বিরোধিতা করে বর্ণনা করাকেই বলা হয় ‘মা’রূফ’ হাদীস। মারুফ হাদীস গ্রহণযোগ্য।

১৮। মুনকার: দুর্বল বর্ণনাকারী কর্তৃক নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর বিরোধিতা করে বর্ণনা করাকেই বলা হয় মুনকার হাদীস। এরূপ বর্ণনাকারীর হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। অন্য ভাষায় মুনকার বলা হয় সেই হাদীসকে যার সনদে এমন এক বর্ণনাকারী আছেন যার বেশী ভুল হয় বা যার অসতর্কতা বৃদ্ধি পেয়েছে কিংবা পাপাচার প্রকাশ পেয়েছে।

১৯। মাহফুয: যে হাদীসটি বেশী নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি তার চেয়ে কম নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির বিরোধিতা করে বর্ণনা করেছেন তাকে বলা হয় ‘মাহফুয’ হাদীস। এ হাদীস গ্রহণযোগ্য।

২০। শাষ: যে হাদীসটি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি তার মতই একাধিক বা তার চেয়ে উত্তম ব্যক্তির বিরোধিতা করে বর্ণনা করেছেন সেটিকে বলা হয় ‘শাব’। এরপ হাদীস গ্রহণযোগ্য নয় ।

২১। মাজহুল ও যে বর্ণনাকারীর সত্ত্বা বা গুণাবলী (অবস্থা) সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না তাকেই বলা হয় ‘মাজহুল’। এরূপ বর্ণনাকারীর হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।

২২। জাহালাত: যে সনদের মধ্যের কোন বর্ণনাকারীর সত্ত্বা বা অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না সে সনদটিকে জাহালাত (অজ্ঞতা) সম্বলিত সনদ বলা হয়।

২৩। ভাবে’ সেই হাদীসকে তাবে’ বলা হয় যে হাদীসের বর্ণনাকারীগণ বাক্য এবং অর্থের দিক দিয়ে অথবা শুধু অর্থের দিক দিয়ে এককভাবে হাদীস বর্ণনাকারীদের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তবে একই সহাবা হতে।

২৪। শাহেদ : সেই হাদীসকে শাহেদ বলা হয় যে হাদীসের বর্ণনাকারীগণ বাক্য এবং অর্থের দিক দিয়ে অথবা শুধু অর্থের দিক দিয়ে এককভাবে হাদীস বর্ণনাকারীদের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তবে ভিন্ন সহাবা হতে।

২৫। মুতাবায়াত ও হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে বর্ণনাকারী অন্য বর্ণনাকারীর সাথে মিল রেখে বর্ণনা করলে তাকে বলা হয় ‘মুতাৰা’য়াত’।

এটি দু’প্রকার :

(ক) মুতাবা’য়াতু তাম্মাহ যদি সনদের প্রথম অংশের বর্ণনাকারীর স্থলে অন্য বর্ণনাকারী মিলে যায়, তাহলে তাকে ‘মুভাবা’য়াতু তাম্মাহ’ বলে।

(খ) মুতাবা’য়াতু কাসিরা যদি সনদের মাঝের কোন বর্ণনাকারীর স্থলে অন্য কোন বর্ণনাকারী মিলে যায় তাহলে তাকে বলা হয় ‘মুতাবা’য়াতু কাসিরা’।

২৬। মুদাল্লাস : সনদের মধ্যের দোষ লুকিয়ে তার বাহ্যিক সৌন্দর্য প্রকাশ করে বর্ণনা করা হাদীসকে ‘মুদাল্লাস’ বলা হয়। আর যে ব্যক্তি এরূপ করে তাকে বলা হয় ‘মুদাল্লিস’ (দোষ গোপণকারী)।

তাদলীস (সনদের দোষ গোপন করা) দু’প্রকার :

(ক) তাদলীসুল ইসনাদ:রাবী (বর্ণনাকারী) কর্তৃক তার শাইখকে লুকিয়ে তার শাইখের শাইখ হতে অথবা তার সমসাময়িক অন্য কোন ব্যক্তি হতে বর্ণনা করা, যার সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটেছে, কিন্তু তার থেকে সে শ্রবণ করেনি।

(খ) তাদলীসুত তাসবিয়া: রাবী কর্তৃক এমন এক দুর্বল বর্ণনাকারী হতে হাদীস বর্ণনা করা, সনদে যার অবস্থান এমন দুই নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর মাঝে যারা একে অপরের সাথে মিলিত হয়েছে। অতঃপর রাবী কর্তৃক সেই দুর্বল বর্ণনাকারীকে কুপিয়ে তার নির্ভরযোগ্য শাইখের মাধ্যমে অপর নির্ভরযোগ্য হতে বর্ণনা করা। (অথচ ন্যায়পরায়ণতার পরিচয় দিয়ে উভয়ের মাঝের দুর্বল বর্ণনাকারীকে উল্লেখ করা উচিত ছিল)। এটি সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্টতম তাদলীস। 

(গ) তাদলীসুশ শয়ূখ: রাবী কর্তৃক মানুষের নিকট তার শাইখের অপ্রসিদ্ধ নাম বা কুনিয়াত বা উপাধি ইত্যাদি উল্লেখ করার মাধ্যমে হাদীস বর্ণনা করা।

মুদাল্লিস বর্ণনাকারী যদি স্পষ্ট ভাষায় শ্রবণ সাব্যস্ত করে, যেমন বলবে আমি শুনেছি, তাহলে গ্রহণযোগ্য হবে। আর যদি স্পষ্টভাবে তার শ্রবণ সাব্যস্ত না করে, (যেমন বলবে অমুক হতে অমুক হতে, যেটাকে বলা হয় আন্ আন্ করে) তাহলে তার হাদীস গ্রহণযোগ্য হবে না।

২৭। মুরসালুল খাফী ৪ রাবী কর্তৃক তার সমসাময়িক এমন ব্যক্তি হতে হাদীস বর্ণনা করা যার সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটার ব্যাপারটি জানা যায় না।

২৮। মাওযু’ নিজে জাল করে রসূল (স)-এর উপর মিথ্যারোপ করাকেই “মাওযূ” হাদীস বলা হয়। (এরূপ বানোয়াট হাদীস বর্ণনা করা হারাম)।

২৯। মুতারিব: আভিধানিক অর্থে মুখতারিব বলা হয় কর্মে ত্রুটিযুক্ত হওয়াকে। আর পারিভাষিক অর্থে সেই হাদীসকে মুখতারিব বলা হয়, যেটি সমশক্তিতে বিভিন্ন রূপে বর্ণিত হয়েছে। যার একটি অন্যটির সাথে সাংঘর্ষিক এবং একটিকে অন্যটির সাথে একত্রিত করেও আমল করা সম্ভবপর হয় না। এরূপ বিভিন্নতা সনদের বর্ণনাকারীদের নাম নিয়েও হতে পারে আবার হাদীসের ভাষাতেও হতে পারে। তবে এরূপ সনদের মধ্যেই বেশী ঘটে থাকে। এরূপ হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।

৩০। মুসাহাফ : আভিধানিক অর্থে তাসহীফ বলা হয় লিখতে এবং পড়তে ভুল করাকে। পারিভাষিক অর্থে মুসাহাফ বলা হয় শব্দ অথবা অর্থের দিক দিয়ে নির্ভরযোগ্যদের বর্ণনার বিরোধিতা করে হাদীসের শব্দে পরিবর্তন ঘটানোকে। তাসহীফ সংঘটিত হয় সনদ এবং মাতান (হাদীসের ভাষা) উভয়ের মধ্যে। সাধারণত শিক্ষক বা শাইখের নিকট শিক্ষা গ্রহণ না করে গ্রন্থরাজী হতে হাদীস গ্রহণকারী রাবী তাসহীফ-এর মধ্যে পতিত হয়ে থাকেন। নির্ভরযোগ্যদের হাফিয ইবনু হাজারের (রহঃ) নিকট মুসাহাফ বলা হয় বর্ণনার বিরোধিতা করে হাদীসের সনদে ব্যক্তির নামের বা হাদীসের ভাষার কোন শব্দের অক্ষরের এক বা একাধিক নুকতাকে শব্দের আকৃতি ঠিক রেখে পরিবর্তন করাকে।

৩১। মুদরাজ: আভিধানিক অর্থে কোন বস্তুকে অন্য কোন বস্তুর মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়াকেই বলা হয় ‘মুদরাজ’ বলা হয়। আর পারিভাষিক অর্থে মুদরাজ বলা হয় সনদের মাঝে কারণ বশতঃ বর্ণনাকারীর পক্ষ হতে কোন কিছু সংযোজন করাকে অথবা হাদীসের ভাষ্যে যা তার অন্তর্ভুক্ত নয় এরূপ কিছুর প্রবেশ ঘটিয়ে তার সাথে মিশিয়ে দেয়াকে (পৃথকভাবে উল্লেখ না করে)। মুদরাজ গ্রহণযোগ্য নয়, বরং হারাম। তবে যদি ব্যাখ্যা মূলক হয় তাহলে তা নিষিদ্ধ নয়।

যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৩য় খন্ড

যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৩য় খন্ড

Reviews (0)

Reviews

There are no reviews yet.

Be the first to review “যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৩য় খন্ড”

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping cart
Facebook Twitter Instagram YouTube WhatsApp WhatsApp

Sign in

No account yet?