‘লাগ ভেল্কি লাগ, চোখে মুখে লাগ’, ভেল্কি ঠিকই লেগেছে। তবে শুধু চোখে মুখেই নয়, গোটা দেহের সকল অঙ্গে, মনে মগজে, চালে চলনে আর চরিত্রে, সভ্যতা সংস্কৃতিতে, ইতিহাস আর ঐতিহ্যে, সমাজের স্তরে স্তরে, বেশ ভূষা সাজ সাজ সজ্জা আর পোশাক পরিচ্ছদে। আমাদের কথা হলো যা আসছে আসতে দাও, ভালমন্দের বিচার করা যাবে না, বরণ করে নাও। নতুনত্বের মাঝে হারিয়ে যাও, লীন হয়ে যাও। নারী স্বাধীনতার নামে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির অনুকরণে শ্লোগান তোল। সেই সাথে ১লা বৈশাখকে বরণ করে নাও, আবার ১লা ফাল্গুনকে, ১লা জানুয়ারীকেও বাদ দিও না। আর বরণ করার অযুহাতে বাজার থেকে বাহারী কাপড় চোপড় কিনে কোন্ দিবসে কি পোশাক পরতে হবে এটা দিন দিন যেন বৃহত্তর কলেবরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফায়দা লুটছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। তারা দিবসকে সামনে রেখে বাহারী পোশাক বিক্রি করে। যুবতীরা হুমড়ি পেয়ে পড়ছেন দোকানে। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পর্যন্ত এখন এই সংবাদ পৌঁছে পেছে। বৈচিত্র্যের মধ্যে হারিয়ে যেতেই যেন আমরা পছন্দ করি। কি ভাল, কি মন্দ কোন বাছ বিচার নেই। আমাদের সংস্কৃতির উদরে সবই ঢুকে যাচ্ছে। কারণ আমরা উদার সংস্কৃতিমনা। এই উদারতার দাবি মিটাতে গিয়ে নারী স্বাধীনতার নামে সমঅধিকারের দাবি উঠেছে। নারী দিবসে প্রগতিশীল নারীরা সমঅধিকারের কথা বলতে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে থাকেন। তাদের দাবি শত ভাগ বাস্তবায়ন হয়নি বলে। আমি বলি যত ভাগই বাস্তবায়ন হয়েছে, শান্তি, অধিকার কতটা মিলেছে? নারী আমাদের সমাজে অবহেলিত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত একথা আজ সত্য। কিন্তু কেন এ অবস্থা তা আমরা জানি না, অনেক ক্ষেত্রে জানতে চাইও না। যা ও বা জানি, ভুল জানি। আমরা মনে করি সংসার থেকে বের হয়ে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারলেই বুঝি এই অবহেলা ঘুচবে। সমঅধিকার লাভ হবে। বঞ্চনা দূর হবে। কিন্তু আমরা নারীরা জানি না, কোথায় আমরা অধিকার হারাচ্ছি। একটা মেয়েকে ছেলের মতো আদর যত্নে লালন পালন করার দায়িত্ব পিতামাতার। তাকে লেখাপড়া শেখাতে হবে, পাশাপাশি দ্বীনি শিক্ষাও দিতে হবে। লেখাপড়া, দ্বীনি শিক্ষা আলাদা আলাদাভাবে বলার কারণ হলো- আজকের যুগে লেখাপড়া শিখে সত্যিকার মানুষ অথবা মুসলমান হওয়া যায় না। এ লেখাপড়ায় দ্বীনি শিক্ষা অনুপস্থিত। দ্বীনি শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে বড় হলে তার অধিকার সম্পর্কে সে সচেতন হতে পারবে। মেয়েকে সৎ পাত্রস্থ করা মা-বাবার দায়িত্ব। একটা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলেও পিতার সম্পত্তিতে সে ছেলের অর্ধেক পায়। এটা নিয়েও আমাদের নারী নেত্রীরা সোচ্চার। এখানে তারা নারীদের সাথে বেইনসাফী করা হয়েছে বলে জোরালো বক্তব্য রাখেন। তাদের জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, একটি ছেলের একটা সংসার থাকে। সে হয় সংসারের কর্তা। সংসারের সকল সদস্যের ভরনপোষণের দায়িত্ব তার। অপর পক্ষে মেয়েটি স্বামীর ঘরে গিয়ে নিজের সংসার শুরু করে। কিন্তু সে সংসারে খরচের দায়িত্ব তার নয়। যেমন পিতামাতার তেমনি স্বামী সন্তানদের ভরনপোষনের দায়িত্বও কিন্তু মেয়ের নয়, এদিক দিয়ে সে কতবড় একটা আর্থিক নিরাপত্তা লাভ করছে এই সম্পত্তির মাধ্যমে। এটা এজন্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত যাতে মেয়েরা নিরাপত্তাহীনতায় না ভুগে। কিন্তু আফসোস আজকের সমাজে পিতা ছেলেদেরকেই কেবল সম্পত্তির ভাগ দিচ্ছেন। মেয়েদেরকে নয়। ভাইদেরও বক্তব্য হলো বোনকে লেখাপড়া শিখায়ে খরচ করে বিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন সে বাপের বাড়ীতে মেহমান হিসেবে আসবে। যদি কোন নারীকে স্বামী গৃহ থেকে চলে আসতে হয়, তখন সে হয় ভাই-এর সংসারের বোঝা, চাকরানী। দুর্বিসহ সে জীবন। কোথায় আমার নারীবাদী বোনেরা? এদের নিরাপত্তা কে দেবে? এব্যাপারে নিজের প্রাপ্য বুঝে নেয়ার জন্য সংগ্রাম করুন, কাজে লাগবে। এবার স্বামীর সংস্কারের দিকে আসা যাক। স্বামীর সংসারে স্ত্রী হলো সংসার রাজ্যের রাণী। তাকে আদর, যত্ন, মর্যাদাসহ এই গৃহে অবস্থানের সবরকমের সুযোগ সুবিধা দান করা স্বামীর কর্তব্য। স্ত্রীকে তুচ্ছ জ্ঞান করা, কথায় কথায় হেয় প্রতিপন্ন করা, অসম্মানজনক কথা বলা যাবে না। এমনকি ঘরের কাজ করার জন্যও তাকে বাধ্য করা যাবে না। এসবই কুরআন হাদীসের নির্দেশ। ইসলাম এতকিছুর পরও স্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য মোহরানার ব্যবস্থা রেখেছে। এ মোহরানা যে আমার প্রগতিশীল বোনেরা পাচ্ছেন না তা বলাই বাহুল্য। কারণ আমরা জানি এটা সঠিকভাবে আদায় হয় না। অথবা এটাকে আদায় করা লজ্জাস্কর ব্যাপার বলে মনে করেন নারীরা। অথচ ইসলাম বলে বিয়ের রাতে স্বামী স্ত্রীকে স্পর্শ করার আগেই এই মোহরানা পুরোটা অথবা একটা অংশ আদায় করে দিতে হবে। আদায় না করলে বিয়ে শুদ্ধ হবে না, সম্পর্ক জ্বিনার পর্যায়ে চলে যাবে। এই মোহরানা ছাড়াও স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির দুই আনা হকদার। নারীবাদী বোনদেরকেক এ ব্যাপারে অধিকার আদায়ের সংগ্রামের আহবান জানানো। এবার আসেন সন্তানের কাছে। সন্তান মায়ের সেবা যত্ন করে জান্নাতে যাবে। এ ব্যাপারে একটা হাদীস উল্লেখ করছি। হযরত আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্নিত, ‘‘এক ব্যক্তি এসে রাসূলে করীম (সা:)কে জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল! আমার ভাল ব্যবহার পাবার সবচেয়ে বেশি অধিকারী কে? তিনি বলেন, তোমার মা। সে জিজ্ঞেস করলো; অতঃপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বললো- তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে জানতে চাইলো- তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার পিতা।’’ বুখারী শরীফ। অতএব দেখা যাচ্ছে, ইসলাম পিতার চেয়ে মাকে ৩ গুণ বেশি মর্যাদা দান করেছে। এছাড়াও হাদিসে রয়েছে- ‘‘জান্নাত মায়ের পায়ের নিচে।’’ অর্থ্যাৎ মায়ের সেবা যত্ন করে সন্তুষ্টি অর্জন করলে জান্নাত পাওয়া যাবে। এত সম্মান যে মায়ের সে মায়ের অবস্থার দিকে আমাদের নারী নেত্রীদের দৃষ্ট আকর্ষণ করছি। এখন মায়েরা ছেলের সংসারে বোঝাস্বরূপ। ছেলে স্ত্রী নিয়ে ফূর্তি করার সময় মায়ের কথা তার মনেই থাকে না। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না এই ছেলের সম্পত্তিতেও মায়ের নির্ধারিত অংশ রয়েছে। এবার চিন্তা করে দেখুন, একজন মেয়ের কত দিকে সম্পত্তির অংশ পাওনা রয়েছে। কিন্তু খরচের জন্য আল্লাহ একটা ঘাতও নির্ধারণ করে দেননি। অর্থাৎ আল্লাহ তাকে নিজের খরচের জন্যও বাধ্য করেননি। পিতা, স্বামী, সন্তান তার খরচ বহন করতে বাধ্য। এরপরও কি বলতে চান মেয়েদের প্রতি বেইনসাফ করেছে ইসলাম। নাউযুবিল্লাহ। আল্লাহ আমাদের মাফ করুন। ঘরে আমার সম্পদ রেখে না জানার কারণে বাইরে এসে চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছি অধিকার আদায়ের জন্য। যা আমাকে অধিকার দেয়ার পরিবর্তে অধিকার হরণ করছে। একজন মহিলা ইচ্ছে করলে তার সংসার চালিয়ে সময় করে বাইরে কাজ করতেই পারেন। কিন্তু কাজের নামে বাইরে নিজের রূপ সৌন্দর্যের প্রদর্শন করে বেড়ালে ঘরে যেমন শান্তি নষ্ট হবে, তেমনি বাইরেও তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন। যার যার সীমানার মধ্যে থেকে অধিকার ভোগ করা উচিত। বিদ্যুতের পজিটিভ ও নেগেটিভ দুটো তার মিলে আলো জ্বলে। দুটো স্ব স্ব অবস্থান থেকে আলো জ্বালানোর কাজ করে। পজিটিভ ও নেগেটিভ এক করে দিলে আগুন জ্বলে ওঠে। কিন্তু আমাদের নারী-বাদীরা চান পজিটিভ ও নেগেটিভ এক হয়ে কাজ করতে। তাহলে সংসার নামক প্রতিষ্ঠানটি যেখান থেকে শান্তি, নিরাপত্তা ও সুসন্তান আসবে সে প্রতিষ্ঠানের কি হবে? তাই বলে আমি বাইরে কাজ করার বিরুদ্ধে কথা বলছি না। প্রয়োজনে অথবা অপ্রয়োজনে নিজের পড়াশুনাকে কাজে লাগানোর জন্য, সমাজসেবার জন্য অবশ্যই চাকরি করতে পারেন। যেসব কাজে নারীকে মানায় কেবল সেসব কাজ করা যাবে। প্রত্যেক বিভাগে পুরুষের পাশাপাশি নারীকে অবশ্যই কাজ করতে হবে। এমনটা ভাবা উচিত নয়। অনেক প্রগতিবাদী নারী নেত্রীকে বলতে শুনেছি, তিনি যখন ট্রাকের উপর নারী শ্রমিককে মাটি কাটার উপকরণসহ পুরুষের পাশাপাশি দেখেন তখন তার খুব ভাল লাগে এই ভেবে যে, নারীরা আর পিছিয়ে নেই। নারী জাগরণ শুরু হয়েছে। আফসোস এমন বক্তব্য শুনার জন্য এবং আপনাদের শুনানোর জন্য। নারীকে আল্লাহ যে দৈহিক গঠন দান করেছেন তা দিয়ে সে এমন কাজ করবে যা পুরুষের সম্মান বা কোন কোন ক্ষেত্রে অধিক। সে পুরুষ রাষ্ট্র পরিচালনা করছে তাকে একজন মা (নারী) গঠন করে দিয়েছেন। এই মা যেমন তার সন্তানও তেমন। এই মায়ের পাঠশালায় তৈরি হয় দেশবরেণ্য ওলী, দরবেশ, মন্ত্রী ও রাষ্ট্রনায়কদের। তাইতো নেপালিয়ান বলেছিলেন– “Give me a good mother I will give you a good no nation.” ইসলাম নারীকে পাত্র পছন্দ করার স্বাধীনতাও দিয়েছে। তার মতামত নিয়ে তবে পিতামাতা তাকে বিয়ে দিবেন। অথচ আজকাল শুনা যায় ছেলেরা নাকি সুন্দরী ও চাকরিজীবী স্ত্রী চায়। আগে চাইতো কেবল যৌতুক। আরো কতো কৌতুক করবে প্রগতিশীল ছেলেরা। কারণ আজকাল বেপর্দার কারণে নারীরা তাদের কাছে সহজলভ্য। আমরা নারীরা আমাদের অধিকারের কথা জানি না। বলেই পদে পদে মার খাচ্ছি। পিতার সম্পত্তির ভাগ আদায় করছি না বলে, স্বামী যখন নানাভাবে কষ্ট দেয়, তখন এই নারী লাঞ্ছনার শিকার ….. মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। কারণ তারতো যাওয়ার জায়গা নেই। পিতার অবর্তমানে ভাই-এর সংসারে বোঝা হতে সে ভয় পায়। অথচ ইসলাম তাকে স্বামীর কাছ থেকে মোহরামা দিয়েছে; পিতার সম্পত্তিতে ভাই এর অর্ধেক সম্পত্তি দিয়েছে। সে একাই দাঁড়াতে পারে। তাই সম অধিকারের নামে প্রবঞ্চনা ক্রয় না করে সব পরিমন্ডলে দায়িত্ব পালন করা কর্তব্য।
সম অধিকার নয় মর্যাদা চাই
৳ 20
রাজিয়া আব্দুর রাজ্জাক
Reviews (0)
Be the first to review “সম অধিকার নয় মর্যাদা চাই” Cancel reply
Reviews
There are no reviews yet.