সলাত পরিত্যাগকারীর হুকুম
সলাত পরিত্যাগকারীর হুকুম
মূল : আল্লামা মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.)
অনুবাদ : আল-আমীন বিন ইউসুফ
প্রকাশনায় : দারুল কারার পাবলিকেশন্স
বিষয় : সলাত
পৃষ্ঠা : ৭২, কভার : পেপার ব্যাক,
বইটি কিনতে কিল্ক করুন: সলাত পরিত্যাগকারীর হুকুম
আরো জানতে কিল্ক করুন: তাওহীদ পাবলকিশেন্স
সলাত পরিত্যাগকারীর হুকুম
حكم تارك الصلاة
সলাত
পরিত্যাগকারীর হুকুম
মূল :
আল্লামা মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ:)
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আল-আমীন বিন ইউসুফ
দাওরা হাদীস, মাদরাসা মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া, ঢাকা
কামিল (এম.এ), মাদরাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা
ও
হাফেয রায়হান কবীর বিন আব্দুর রহমান
দাওরা হাদীস, মাদরাসা মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া, ঢাকা
অনার্স-মাস্টার্স (ইসলামিক স্টাডিজ), কবি নজরুল সরকারী কলেজ, ঢাকা
কামিল (হাদীস), সরকারি মাদরাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা
সলাত পরিত্যাগকারীর হুকুম
অনুবাদকের আরয
إن الحمد لله والصلاة والسلام على سيد الأنبياء والمرسلين وآله وصحبه ومن
تبعهم بإحسان إلى يوم الدين وبعد
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের জন্য যাবতীয় প্রশংসা যিনি মানবমণ্ডলীকে সর্বোত্তম দৈহিক আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন এবং সলাতকে সর্বোত্তম ইবাদত হিসেবে ভূষিত করেছেন। অতঃপর দরূদ ও শান্তি বর্ষিত হোক মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবারবর্গ এবং কিয়ামত পর্যন্ত সকল সৎকর্মশীলগণের উপর।
আল্লাহ তা’আলা মি’রাজ রজনীতে মানব জাতির জন্য পাঁচ ওয়াক্ত সলাত ফরয করেছেন। এই সলাত হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম ইবাদত। যে ইবাদতের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়।
সর্বোত্তম এ ইবাদত পরিত্যাগকারীর জন্য বিভিন্ন হাদীসে শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। এ সলাতকে অবজ্ঞাবশত ও ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগকারী কাফের হয়ে যাবে। তবে অনিচ্ছাকৃতভাবে এবং অলসতাবশত কেউ তা বর্জন করলে তার বিধান কী হবে সে বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনার অবকাশ রয়েছে।
এ ব্যাপারে আলেম সমাজ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। কতক আলেম ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত উভয় প্রকার সলাত পরিত্যাগকারীকে সাধারণভাবে কাফের সাব্যস্ত করেছেন এবং এ সম্পর্কে বিভিন্ন দলীলও পেশ করেছেন। অপরদিকে যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী সলাত বর্জনকারীকে ঢালাওভাবে কাফের সাব্যস্ত করার বিপরীত মত ব্যক্ত করেছেন। তিনি এ সম্পর্কিত বিভিন্ন দলীল-দালায়েল তুলে ধরে প্রমাণ করেছেন যে, অনিচ্ছাকৃত ও অলসতাবশত সলাত বর্জন করলে সে কাফের হয় না।
আমরা এ বিষয়টি জনসমক্ষে প্রচার করার লক্ষে শায়খের লিখিত- সলাত পরিত্যাগকারীর হুকুম বইটি অনুবাদ করতে দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করি। আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে তা শেষ হলো।
সলাত পরিত্যাগকারীর হুকুম বইটির সম্পাদনা করেছেন মাদরাসা মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়ার ফারেগি ছাত্র সোহেল মাহমূদ ও অধ্যয়নরত ছাত্র আব্দুল হাই বিন আশফাকুর রহমান বগড়াবী। আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দিন।
মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তাই পাঠকবৃন্দের নিকট অনুরোধ, অনুবাদের ক্ষেত্রে কোন প্রমাদ পরিলক্ষিত হলে জানিয়ে বাধিত করবেন। ইনশাআল্লাহ পরবর্তী সংস্করণে তা সংশোধন করা হবে।
বিনীত
মুহাম্মাদ আল-আমীন বিন ইউসুফ
হাফেয রায়হান কাবীর বিন আব্দুর রহমান
সলাত পরিত্যাগকারীর হুকুম
সূচিপত্র
- অনুবাদকের আরয
- সলাত পরিত্যাগকারীর হুকুম
- বিশিষ্ট আলেমদের অভিমত
- লেখকের ভূমিকা
- শাফা‘আতের হাদীস
- কতক আলিমের সন্দেহ
- গবেষণা ও পর্যালোচনা
- কুফর দু’ প্রকার
- আমলগত কুফরের কারণে কোনো মুসলিম ব্যক্তি ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় না
- একটি উলেখযোগ্য ঘটনা
- ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহ.)-এর অভিমত
- আহমাদ বিন হাম্বালের (রহ.) অভিমত
- সারকথা
- বিশেষ দ্রষ্টব্য-১
- বিশেষ দ্রষ্টব্য-২
- অনুবাদকের অন্যান্য বই
সলাত পরিত্যাগকারীর হুকুম
সলাত পরিত্যাগকারীর হুকুম
প্রশংসা মাত্রই মহান আল্লাহর। তাঁর গুণকীর্তন করি, তাঁর নিকট সাহায্য এবং ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং আমাদের আত্মার অনিষ্টতা-অমঙ্গল ও যাবতীয় মন্দ কর্ম থেকে তাঁর নিকট আশ্রয় চাই। তিনি যাকে হেদায়েত দান করেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না। আর তিনি যাকে হিদায়াতের তাওফীক না দেন, তাকে কেউ হেদায়েত করতে সক্ষম নয়। আমি আরও সাক্ষ্য প্রদান করছি, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো মা’বূদ নেই। তিনি এক, তাঁর কোনো অংশিদার নেই। আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি, মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর প্রেরিত রাসূল।
হাম্দ এবং না’তের পর আলোচ্য বিষয়টি হচ্ছে- ইসলামের দ্বিতীয় রূকন “সলাত”। কোনো ব্যক্তি যদি মহান আল্লাহর এই ফরয বিধান পরিত্যাগ করে, তাহলে সেই ব্যক্তি সম্পর্কে শরীয়তের হুকুম কী?
মুসলিম সমাজে এ ব্যাপারে কোনো মতপার্থক্য নেই যে, ইচ্ছাকৃতভাবে ফরয সলাত পরিত্যাগ করা সবচেয়ে বড় পাপ এবং সবচেয়ে বড় কাবীরা গুনাহ। আর এর পাপ হচ্ছে কোনো মানুষকে হত্যা করে তার ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নেয়ার চেয়েও মারাত্মক। অনুরূপভাবে ব্যভিচার, চুরি এবং অলসতা প্রদর্শন এক পর্যায় ইসলামের এ মহান রুকন ত্যাগ করার দিকে ধাবিত করবে।”
এ সকল বিদ্বান অথবা বিদ্যা অর্জনকারীরা তাদের উক্ত মতের স্বপক্ষে কুরআন ও হাদীস থেকে দলীল পেশ করেছেন, কিন্তু এ সংক্রান্ত যত হাদীস রয়েছে সবগুলো উপস্থাপন করেননি। কারণ যদি সমস্ত হাদীস উপস্থাপন করা হয় তাহলে বিষয়টি হালকা হবে এবং এক পর্যায়ে দলীলগুলো বিপরীত পক্ষকে সমর্থন করবে। আমিও এ মহৎ মাসআলায় মতানৈক্যকারীদের প্রমাণাদি ও মতানৈক্যের কেন্দ্র এবং তার প্রতি গভীর মনোনিবেশন করব না। কারণ এর জন্য আলাদা স্থান উপযুক্ত মনে করি।
তবে আমি এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি যা সচরাচর অনেক জ্ঞান অন্বেষণকারীরা অবগত নয়।
প্রথমত : ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল তার ছাত্র ইমাম হাফেজ মুসাদ্দাদ ইবনু মুসারহাদকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন : “আল্লাহর সাথে শরীক করা ছাড়া কোনো বিষয় ইসলাম থেকে বান্দাকে বের করে দেয় না।”১১ অথবা আল্লাহর ফরয বিধানগুলোর মধ্যে কোনো একটি ফরয বিধানকে অস্বীকারবশত প্রত্যাখ্যান করলে (ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়)। যদি কেউ কোন বিধান অলসতা কিংবা অবজ্ঞাবশত ছেড়ে দেয় তাহলে তা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। ইচ্ছা করলে আল্লাহ তাকে শাস্তি দিতে পারেন। কিংবা ক্ষমা করতে পারেন। আমার মতে, কুরআন ও হাদীসে সলাত পরিত্যাগের বিষয়টি (আম) সাধারণভাবে এবং (খাস) বিশেষভাবে এসেছে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
اِنَّ اللهَ لَا يَغْفِرُ اَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ
১১. যেমন : তাবাকাতু হানাবিলা (১/৩৪৩) নামক গ্রন্থে রয়েছে। ১২. ইবনু তাইমিয়া (হিমালয় ) প্রণীত ‘আল-ঈমান’ নামক গ্রন্থের ২৪৫ পৃষ্ঠা।
সলাত পরিত্যাগকারীর হুকুম
মদ্যপান করার চেয়েও বড় পাপ। সে দুনিয়া ও আখিরাতে অপদস্ত হবে এবং আল্লাহর শাস্তির সম্মুখিন হবে।’
রাসূলুল্লাহ থেকে সলাত পরিত্যাগকারী বা সলাতের ব্যাপারে অলসতাকারী অথবা সলাতকে তুচ্ছ মনেকারীর পাপ ও গুনাহ সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যথা-
রাসূলুল্লাহ – ইরশাদ করেছেন,
بَيْنَ الْعَبْدِ وَبَيْنَ الشِرْكِ تَرْكُ الصَّلَاةِ
“মুসলিম এবং মুশরিকদের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে সলাত ত্যাগ করা।
রাসূলুল্লাহ এ ইরশাদ করেছেন :
১. কিতাবুস সলাত ওয়া হুকমু তারিকিহী, পৃষ্ঠা ১৬- ইবনুল কায়্যিম সলাতের ফযিলত সম্পর্কে এবং যে ব্যক্তি সলাত ত্যাগ করে এবং এর প্রতি অলসতা করে তার শাস্তি সম্পর্কে অনেক আয়াত বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন-
فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلوةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا – إِلَّا مَنْ تَابَ
“অতঃপর তাদের পর আসলো অপদার্থ পরবর্তীরা, তারা সলাত বিনষ্ট করেছিল, আর প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছিল। তারা অচিরেই ধ্বংসের সম্মুখীন হবে। তবে তারা বাদে যারা তাওবাহ করবে” (সূরাহ মারইয়াম ১৯ : ৫৯-৬০)
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন-
فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ – الَّذِينَ هُمْ عَن صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ – الَّذِينَ هُمْ يُرَاءُونَ – وَيَمْنَعُونَ الْمَاعُونَ
“অতএব দুর্ভোগ সে সব সলাত আদায়কারীর, যারা নিজেদের সালাতের ব্যাপারে উদাসীন, যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে এবং প্রয়োজনীয় গৃহসামগ্রী দানের ছোট খাট সাহায্য করা থেকেও বিরত থাকে।” (সূরাহ আল-মা’উন ১০৭ : ৪-৭)
অন্যত্র মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
مَا سَلَكَكُمْ فِي سَفَرَ – قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ
“কিসে তোমাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে গেছে? তারা বলবে, ‘আমরা সলাত আদায়কারী লোকদের মধ্যে শামিল ছিলাম না।” (সূরাহ আল-মুদ্দাস্সির ৭৪ : ৪২-৪৩)
সলাত পরিত্যাগকারীর হুকুম
এছাড়াও এ সম্পর্কে আরো অনেক আয়াতে কারীমা রয়েছে যেগুলো আমাদের কর্ণকুহরে বার বার ধাক্কা দেয়।
اَلْعَهْدُ الَّذِي بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمْ الصَّلَاةُ فَمَنْ تَرَكَهَا فَقَدْ كَفَرَ
“আমাদের এবং তাদের (মুশরিক) মাঝে অঙ্গীকার হচ্ছে সলাত আদায় করা। অতএব, যে ব্যক্তি সলাত ত্যাগ করল, সে কুফরি করল।
রাসূলুল্লাহ এ ইরশাদ করেছেন :
مَنْ تَرَكَ الصَّلَاةَ مُتَعَمِّدًا فَقَدْ بَرِئَتْ مِنْهُ ذِمَّةُ اللهِ
“যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে সলাত ছেড়ে দিল, আল্লাহর দায়িত্ব সেই ব্যক্তি থেকে মুক্ত হয়ে গেল।
আমার মতে, কুরআন-হাদীসের এ সকল দলীলের আলোকে সেচ্ছায় সলাত ত্যাগকারীর ‘কাফের’ হওয়া নিয়ে উলামায়ে কিরাম এবং ইমামগণ মতপার্থক্য করেছেন।
বিশিষ্ট আলেমদের অভিমত
ইমাম বাগাবী (রহ:) তাঁর শারহুস সুন্নাহ গ্রন্থে বলেন : ইচ্ছাকৃতভাবে ফরয সলাত ত্যাগকারী কাফের হবে কিনা- এ ব্যাপারে বিদ্বানগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। অতঃপর এ বিষয়ে বিভিন্ন মতামত পেশ করেছেন এমন কতিপয় মনীষীদের নাম উল্লেখ করেছেন। (২য়খণ্ড ১৭৮-১৭৯ পৃ.)
আল্লামা শাওকানী ‘নাইলুল আওতার’ গ্রন্থে পূর্ব উল্লিখিত জাবির কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটির টীকায় বলেন, হাদীসটি দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, সলাত ত্যাগ করা কুফরকে আবশ্যক করে। আর যে ব্যক্তি সলাত ফরয হওয়াকে অস্বীকার করত তা ত্যাগ করে তাহলে সকল মুসলিমের ঐক্যমতে সে কাফের। হ্যাঁ, যদি নতুন ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী হয়, কিংবা মুসলিমদের সাথে এ পরিমাণ সময় চলাফেরা করার সুযোগ না পেয়ে থাকে যে, সলাতের আবশ্যকীয়তা তার নিকট পৌঁছেনি; তাহলে উক্ত ব্যক্তির কথা ভিন্ন।
আর যদি কোনো ব্যক্তি সলাতের আবশ্যকীয়তা সম্পর্কে অবগত থাকে এবং তা বিশ্বাস রাখে; কিন্তু অলসতাবশত ছেড়ে দেয়- যেমন আমাদের সমাজে এরকম অনেক মানুষ রয়েছে-“ এরূপ ব্যক্তিদের ব্যাপারে উলামাদের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে।
জমহুর (অধিকাংশ) সালাফ (পূর্ববর্তী) এবং খাল্ল্ফ (পরবর্তী) আলেমগণ এ ব্যাপারে মতামত দিয়েছেন। তন্মধ্যে ইমাম শাফেঈ ইমাম মালেক এর মতে সে কাফের হবে না; বরং সে ফাসেক। অতএব যদি সে তওবা করে ফিরে আসে তাহলে মুক্তি পাবে। নতুবা আমরা তাকে বিবাহিত ব্যভিচারীর শাস্তির ন্যায় হৃদ মেরে হত্যা করব।
ইমাম ইবনু হিব্বান তাঁর সহীহ গ্রন্থে (৪/৩২৪) পৃষ্ঠায় বলেন, রাসূলুল্লাহ এ সলাত ত্যাগকারীর উপর ‘কুফর’ শব্দটি এ জন্য প্রয়োগ করেছেন যেহেতু সলাত পরিত্যাগ করা ‘কুফর’ শুরু হওয়ার প্রাথমিক ধাপ। কেননা, মানুষ যখন সলাত ছেড়ে দেয় তখন সে অন্যান্য ফরযসমূহকে ত্যাগ করা আরম্ভ করে দেয়। আর যখন সে যাবতীয় ফরয আমল ত্যাগ করা শুরু করে দেবে তখন এক পর্যায়ে সেটাকে (ফরযসমূকে) অস্বীকার করার দিকে ধাবিত হবে- এ জন্য রাসূলুল্লাহ শেষ ধাপের কথাটিকে প্রথমেই প্রয়োগ করেছেন।
অতঃপর ইবনু হিব্বান অধ্যায় রচনা করে তাতে এমন হাদীস উল্লেখ করেছেন আমরা যা উল্লেখ করেছি তা সঠিক হিসেবে প্রমাণ করে। সে অধ্যায়টি হল যা শেষে সংঘটিত হবে এমন বস্তুকে শুরুতে আরবরা উল্লেখ করে থাকে।”
সলাত পরিত্যাগকারীর হুকুম
এ প্রসঙ্গে তিনি রাসূলুল্লাহ এর ‘আল-কুরআনের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা কুফর” কথাটি উল্লেখ করে বলেন : কোনো সন্দেহপোষণকারী মুতাশাবেহ আয়াত সমূহের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতে পারে যা এক প্রকার অস্বীকার করা- এমন ভেবে রাসূলুল্লাহ প্রথমেই তথা ‘সন্দেহ’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন।
সুতরাং সলাত পরিত্যাগ করা ভয়াবহ এবং মারাত্মক একটি বিষয় যা দ্বীন ইসলাম থেকে মানুষকে বের করে দেয় এবং কাফের ও মুশরিকদের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়। (এ জন্য আল্লাহ তা’আলার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি)
আর যখন এ গুরুত্বপূর্ণ মাস’আলার বিষয়ে উলামায়ে কিরাম এবং ইমামদের মাঝে মতভেদ রয়েছে সে জন্যই জ্ঞান অন্বেষণকারীদের উপর আবশ্যক হল, এ বিষয়ে গভীরভাবে জ্ঞান অর্জন করা। ঢালাওভাবে প্রত্যেক সলাত পরিত্যাগকারীকে কাফের বা মুরতাদ শব্দ ইত্যাদি না বলা।
কারণ, সূর্যের ন্যায় স্পষ্ট প্রমাণ ছাড়া একজন মুসলিম ব্যক্তিকে ফতোয়া দিয়ে ইসলাম থেকে বের করে কাফেরদের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া ঐ মুসলিম ব্যক্তি জন্য উচিত নয় যে আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে। কেননা, সহীহ হাদীসে অনেক সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ বলেন-
مَنْ قَالِ لِأَخِيهِ : يَا كَافِرُ فَقَدْ بَاءَ بِهَا أَحَدُهُمَا
অর্থাৎ “যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইকে বলে ‘হে কাফের’ তাহলে দু’জনের মধ্যে যে কোনো এক ব্যক্তির প্রতি উক্ত শব্দটি প্রযোজ্য হয়।”
আর বুখারীর বর্ণনায় এসেছে- অর্থাৎ “দু’জনের মধ্যে যে কোনো একজন কাফের হয়ে যাবে।”
সুতরাং এ সমস্ত হাদীস এবং এ বিষয়ে আরো যে সব হাদীস রয়েছে সেগুলো কাউকে দ্রুত কাফের না বলার জন্য সতর্ককারী এবং বিরাট উপদেশ প্রদান করছে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন :
وَلكِنْ مَنْ شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا
অর্থাৎ “কিন্তু যে ব্যক্তি কুফরীর জন্য তার হৃদয়কে উন্মুক্ত করে দেয়। সুতরাং জরুরী বিষয় হচ্ছে, যে ব্যক্তি কুফরি কাজের প্রতি তার হৃদয়কে উন্মুক্ত করে দেয় এবং অন্তর তাতে প্রশান্তি পায় তখন অন্তর কুফরির দিকেই ধাবিত হয়। ১
তবে হ্যাঁ, কতক বিদ্বান অথবা বিদ্যা অর্জনকারীদের আবেগ ও ঈর্ষা তাদেরকে এ ফাতওয়ার দিকে ধাবিত করেছে যে, “প্রত্যেক সলাত পরিত্যাগকারী কাফের, সে অস্বীকার করে সলাত বর্জন করুক বা অলসতা করে বর্জন করুক। তারা এ ফাতওয়া দিয়েছেন সলাত পরিত্যাগকারীদেরকে ভীতি প্রদর্শন করার জন্য এবং সলাতের প্রতি উৎসাহ প্রদানের জন্য। কেননা তাদের ধারণা অনুযায়ী সলাতের প্রতি অলসতা প্রদর্শন এক পর্যায় ইসলামের এ মহান রুকন ত্যাগ করার দিকে ধাবিত করবে।”
সলাত পরিত্যাগকারীর হুকুম
এ সকল বিদ্বান অথবা বিদ্যা অর্জনকারীরা তাদের উক্ত মতের স্বপক্ষে কুরআন ও হাদীস থেকে দলীল পেশ করেছেন, কিন্তু এ সংক্রান্ত যত হাদীস রয়েছে সবগুলো উপস্থাপন করেননি। কারণ যদি সমস্ত হাদীস উপস্থাপন করা হয় তাহলে বিষয়টি হালকা হবে এবং এক পর্যায়ে দলীলগুলো বিপরীত পক্ষকে সমর্থন করবে। আমিও এ মহৎ মাসআলায় মতানৈক্যকারীদের প্রমাণাদি ও মতানৈক্যের কেন্দ্র এবং তার প্রতি গভীর মনোনিবেশন করব না। কারণ এর জন্য আলাদা স্থান উপযুক্ত মনে করি।
তবে আমি এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি যা সচরাচর অনেক জ্ঞান অন্বেষণকারীরা অবগত নয়।
প্রথমত : ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল তার ছাত্র ইমাম হাফেজ মুসাদ্দাদ ইবনু মুসারহাদকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন : “আল্লাহর সাথে শরীক করা ছাড়া কোনো বিষয় ইসলাম থেকে বান্দাকে বের করে দেয় না।”১১ অথবা আল্লাহর ফরয বিধানগুলোর মধ্যে কোনো একটি ফরয বিধানকে অস্বীকারবশত প্রত্যাখ্যান করলে (ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়)। যদি কেউ কোন বিধান অলসতা কিংবা অবজ্ঞাবশত ছেড়ে দেয় তাহলে তা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। ইচ্ছা করলে আল্লাহ তাকে শাস্তি দিতে পারেন। কিংবা ক্ষমা করতে পারেন।
আমার মতে, কুরআন ও হাদীসে সলাত পরিত্যাগের বিষয়টি (আম) সাধারণভাবে এবং (খাস) বিশেষভাবে এসেছে।
২. হাদীসটি ইমাম মুসলিম জাবির হতে বর্ণনা করেছেন। হা. ৮২
৩. মুসনাদ আহমাদ ৫ম খণ্ড, হা. ৩৪৬; তিরমিযী হা. ২৬২৩; ইবনু মাজাহ হা. ১০৭৯ ৪. ইবনু মাজাহ হা. ৪০৩৪; ইমাম বুখারীর আল-আদাবুল মুফরাদ ১৮ পৃ.। এর সনদটি দুর্বল, তবে শাওয়াহেদ থাকার কারণে হাদীসটি শক্তিশালী হয়েছে। দেখুন- ইবনু হাজার আসকালানীর আত্-তালখীসুল হাবীর ২য় খণ্ড ১৪৮ পৃ.; আল্লামা আলবানীর ইরওয়াউল গালীল ৭ম খণ্ড ৮৯-৯১ পৃ.।
৫. এটি রাসূল এর যুগের কথা। রাসূল এর যুগেই যদি এমন হয়ে থাকে, তাহলে বর্তমানে অবস্থা কেমন হতে পারে!
৬. আবূ দাউদ হা. ৪৬০৩, আহমাদ (২/৫২৮), ইবনু আবূ শায়বাহ (১০/৫২), হাকিম (২/২২৩) ইত্যাদি। হাদীসটির সনদ হাসান। দেখুন মিশকাতুল মাসাবীহ ৩৩৬, সহীহ তারগীব ১৩৯।
৭. উক্ত বাক্যটি ইমাম শাওকানী -এর আস-সায়লুল যারার (৪/৫৭৮) নামক গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে।
৮. বুখারী ১০/৪২৭, মুসলিম হা. ৬০; রাবী ‘উমার হতে বর্ণিত। আর বুখারীতে (১০/৩৮৮) উক্ত অধ্যায়ে আবূ যার ৯ হতে বর্ণিত।
৯. সূরা নাহল ১৬ : ১০৬
১০. উক্তিটি ইমাম শাওকানী (রহ) হতে নেয়া হয়েছে।
১১. যেমন : তাবাকাতু হানাবিলা (১/৩৪৩) নামক গ্রন্থে রয়েছে। ১২. ইবনু তাইমিয়া (হিমালয় ) প্রণীত ‘আল-ঈমান’ নামক গ্রন্থের ২৪৫ পৃষ্ঠা।

সলাত পরিত্যাগকারীর হুকুম
Reviews
There are no reviews yet.